দেশে প্রতিদিন গড়ে ৫ বছরের কম বয়সী ৩০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। ভয়াবহ এমন তথ্য দিয়েছে ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও ইনজ্যুরি সমীক্ষা ২০১৬’। আর ১৮ বছরের কম বয়সীদের হিসেব ধরলে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু হয়।
তাই পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ‘কমিউনিটি ভিত্তিক সচেতনতা’ জরুরী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক জাতীয় ক্যাম্পেইন’র উদ্বোধনকালে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।
জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রচারাভিযান শুরু করেছে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশন (এনএডিপি)। আগামী পাঁচ বছর পুরো বাংলাদেশে এই সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলবে।
সম্প্রতি ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশন (এনএডিপি) কর্তৃক আয়োজিত “পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান” এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। উল্লেখ্য পানিতে ডুবা প্রতিরোধে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত রেজ্যুলুশনের মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্রের ওপর যে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে তা বাস্তবায়নে ব্যাপক জনসচেতনতার কোন বিকল্প নেই বলে বক্তারা অভিমত প্রকাশ করেন।
জাতীয় প্রচারাভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এনএডিপির আহ্বায়ক সদরুল হাসান মজুমদার পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর কারণ ও এর প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বলেন, ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে সচেতনতার অভাব ও প্রতিষ্ঠানিক সুপারভিশনের ঘাটতি রয়েছে’।
শিশু মৃত্যুর কারণ ও প্রতিরোধ: ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠানে এনএডিপির আহ্ববায়ক সদরুল হাসান মজুমদার পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ‘কারণ’ এবং এর ‘প্রতিরোধ’ সর্ম্পকে জানাতে গিয়ে বলেন, ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে সচেতনতা ও দেখাশোনার (সুপারিভিশন) অভাব রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর প্রায় ৬০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটার মধ্যে। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, এই সময়ের মধ্যে শহর ও গ্রামে পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে (বাবা মা) নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকেন। অথচ, এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের যদি প্রাতিষ্ঠানিক সুপারভিশনে মধ্যে রাখা যায় তাহলে প্রায় ৮০ ভাগ পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার রোধ করা সম্ভব। যে পরিবারে শিশুর সংখ্যা অধিক সেসব পরিবারে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে যা গবেষণায় প্রমাণিত’। তাই মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আছে প্রতিবন্ধকতা: পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে সামগ্রিকভাবে কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে সদরুল হাসান মজুমদার বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে প্রথমেই সাঁতারের কথা চিন্তা করা হয়। সাঁতার কেবলমাত্র খেলার অংশ নয়; একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবনরক্ষাকারী দক্ষতা। গবেষণায় উঠে এসেছে, ৬ বছর হলেই কোন শিশুকে যদি সাঁতার শেখানো যায়, তাহলে তার পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ৯০ শতাংশ কমে যায়’।
‘পানি থেকে উদ্ধারের পর সঠিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণে অনেক শিশু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়’ জানিয়ে সদরুল হাসান মজুমদার বলেন, ‘পানিতে ডুবে যাওয়া শিশুকে উদ্ধারের পর অবৈজ্ঞানিক ও পুরাতন প্র্যাক্টিসের মাধ্যমে পেট থেকে পানি বের করার চেষ্টা করা হয়। আর সেটা করতে গিয়ে মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করা হয়। কিন্তু শ্বাসনালীতে যাওয়া পানিটা যদি বৈজ্ঞানিক উপায়ে (সিপিআর) বের করা যায় তাহলে তাকে মৃত্যুর হাত থেকে সাময়িক ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আবার পানি থেকে উদ্ধার করার যে বৈজ্ঞানিক উপায় রয়েছে, সেটাও আমাদের জানতে হবে। অথচ পানিতে ডুবে মৃত্যু কারণে হোক, অকারণে হোক, অসচেতনতা বা অবহেলা করে হলেও এখন আর তাকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই’।
খেয়াল রাখতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার: শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর পর পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিশেষ করে মায়েরা মানসিক অবসাদের মধ্য দিয়ে যান উল্লেখ করে সদরুল মজুমদার এ সময় পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। একজন মানুষ বা শিশু যখন অন্য একজন শিশুকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে তখন তার যে মানসিক পীড়ন সৃষ্টি হয় তা অধিকতর গুরুত্বের সাথে যত্ন নেয়া উচিত।
দরকার সমন্বয়: তাই পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে একটি মাল্টি সেক্টরাল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। সেই সঙ্গে একে কেবলমাত্র এনজিওভিত্তিক কার্যক্রম হিসেবে না দেখে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে দেখতে হবে, যাতে করে সমাজের সকলে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এনএডিপির মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আবদুল জলিল চৌধুরী। অনুষ্ঠানে ৬৪ জেলার এনজিও প্রতিনিধিরা এবং জেলার স্থানীয় সাংবাদিক প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ৮ বিভাগের সমন্বয়কদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান, বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক মো. রহিমা সুলতানা কাজল এবং রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়ক তপন কুমার কর্মকার।
পানিতে ডুবে যাওয়া উদ্ধারকৃত শিশুদের চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সাইলা ইমাম কান্তা বলেন, ‘উদ্ধারের পর বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রাথমিক পরিচর্যা না করা হলে পরবর্তীতে চিকিৎসা প্রক্রিয়া জটিল আকার ধারণ করে। তিনি উল্লেখ করেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিশুরা সারা জীবনের জন্য শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন’।
এনএডিপি’র উপদেষ্টাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন লিঙ্গ বৈষম্য ও নারী বিষয়ক অ্যাক্টিভিস্ট সেলিনা আহমেদ এনা এবং মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবুল কালাম মো. হুমায়ূন কবির। আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ডা. ইশাকুল কবির, মালালা ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি মো. মোশাররফ তানসেন। দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ।