শান্তি কে না চায়, মানুষের বহুল প্রত্যাশিত শব্দ এটি। তবে খাগড়াছড়িবাসীর কাছে ‘শান্তি’ শব্দটিই দিনে দিনে ভীষণ অপ্রিয় ও অশান্তির কারণ হয়ে উঠছে। ক্রমাগতভাবেই ভারী হচ্ছে এখানকার সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, অনুযোগ ও অসন্তোষের পাল্লা। আর এর সবই ‘শান্তি পরিবহন’ -কে ঘিরে।
খাগড়াছড়ির সড়কে দুর্ঘটনা যেন নৈমিক্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল দুই সপ্তাহে এখানে পরপর ঘটেছে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা। কখনো নিজে নিজেই উল্টে গেছে শান্তির বাস, কখনো আবার অন্য পরিবহনের সাথে মুখোমুখি সংঘাত। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতও হয়েছে অনেক। মারা গেছে অন্তত দু’জন। এখনো বহু মানুষ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আর এসবের জন্য চালকদের অসতর্কতা, একগুঁয়েমি আর উদাসীনতাকেই দুষছেন যাত্রীরা।
দুর্ঘটনা ছাড়াও শান্তি পরিবহনের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও এন্তার অভিযোগ। চালক ও স্টাফদের অসদাচরণ, চেয়ারকোচ গাড়িতে যত্রযত্র বাড়তি যাত্রী ওঠা-নামা ও পণ্য পরিবহন, খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম রুটে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার, গাড়ি চালানো অবস্থায় ধূমপান, চালকদের মাদকাসক্তি ও বেপরোয়া গতি, ফিটনেস বিহীন গাড়ি পরিচালনা এবং চালকের সহকারী দিয়ে গাড়ি চালনা উল্লেখযোগ্য।
অথচ যে শান্তি পরিবহনের বিরুদ্ধে এতোসব অভিযোগ -সেই শান্তি পরিবহন ছিল খাগড়াছড়ির বাসিন্দাদের দুঃসময়ের ভরসা, দুর্গম পাহাড়ি পথে যাত্রীদের সেবা দেয়া একমাত্র পুরোনো পরিবহন। শান্তি পরিবহন বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হতে নিবন্ধন পাওয়া জেলার সবচে বড় ও প্রভাবশালী পরিবহন সংগঠন ‘খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ’ এর অধীনে। ১৯৯০ সালে ‘খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি’ গঠনের মাধ্যমে পথচলা শুরু হয় শান্তি পরিবহনের। তখন খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়কে এই ব্যানারে কেবল হাতেগোণা কয়েকটি মিনিবাস চলাচল করতো। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কে চারটি চেয়ার কোচ সংযোজনের মাধ্যমে নবযাত্রা শুরু হয় পরিবহনটির। তারও বছর দুয়েক বাদে খাগড়াছড়ি-ঢাকা রুটে যাত্রী আনা নেওয়া শুরু করে তারা। ২০০৪ সালে খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি’র নাম পরিবর্তন করে ‘খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। এরপর একে একে খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাথে যুক্ত হতে থাকেন নবীন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সংগঠনের কলেবর। বাড়তে থাকে নতুন পরিবহনের সংখ্যা এবং বিস্তৃত হতে থাকে চলার পরিধি। বর্তমানে খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ছাড়াও ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মংমনসিংহ, বরিশাল, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও সিলেটসহ পঞ্চাশটির বেশী জেলায় নিয়মিত যাতায়াত করছে শান্তি পরিবহনের চেয়ারকোচ বাস।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন তাদের নিয়মিত চলাচল করা পরিবহনের সংখ্যা প্রায় ১৮০টি। এর মধ্যে চেয়ারকোচ ১৪০টি এবং মিনিবাস রয়েছে ৪০টি। আর খাগড়াছড়ি থেকে প্রাত্যহিক ২২টি নৈশকোচ যাতায়াত করছে খাগড়াছড়ি-ঢাকা রুটে। এই পরিবহনে চালক, সুপারভাইজার, সহকারী এবং কাউন্টারের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে অন্তত আড়াই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। যার বেশিরভাগই খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা। বর্তমানে খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৫ জনে। এরমধ্যে ক্ষমতাসীন দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও জেলার বড় বড় ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে প্রভাবশালী রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন হওয়ায় নিজেদের খেয়াল খুশিমতো পরিবহন পরিচালনা করছেন তারা। সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি ও অভিযোগের কথা কেউই আমলে নিচ্ছেন না। তবে এমন শান্তি পরিবহন চায় না যাত্রী সাধারণেরা। তাদের চাওয়া নিরাপদ, স্বস্তির, শালীন ও সৌহার্দপূর্ণ আন্তরিক সেবা। শান্তি পরিবহন হয়ে উঠুক আগের মতোই আস্থা ও ভরসার পরিবহন।
চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ রানা’র বাড়ি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলায়। খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম রুটে শান্তি পরিবহনের নিয়মিত যাত্রী তিনি। তবে এ পরিবহনে সওয়ারী হওয়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা স্বস্তির নয় তাঁর। তবুও বাধ্য হয়েই যাতায়াত করতে হয় তাঁকে। এ প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কে শান্তি ছাড়া আর কোনো পরিবহন চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে না। একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণেই যাত্রীসেবার মান উন্নত হচ্ছে না। সকল ধরনের পরিবহনকে এই সড়কে চলাচলের অবাধ সুযোগ দেয়া উচিত। তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হবে। যাত্রীরা ভালো সেবা পাবে।’
খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা মো. ফরহাদ মিয়া ও মো. আল-আমিন বলেন, ‘প্রায়শই দেয়া যায় অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালায় এই পরিবহন। এছাড়া দুর্ঘটনায় হতাহতদের কখনো হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবরও নেয় না পরিবহন সংগঠনটির নেতারা। দেয়া হয় না চিকিৎসার জন্য কোনোরকম সহায়তা।’
দীঘিনালা উপজেলার বাসিন্দা আফিফা আফনান বলেন, ‘এদের চালক ও স্টাফদের ব্যবহার খুবই অশালীন। এছাড়া গাড়ি চালনা অবস্থায় চালক সিটে বসেই ধুমপান করেন। পুরুষদের জন্য যেমন-তেমন হলেও এটি নারী যাত্রীদের জন্য ভীষণ অস্বস্তিকর ব্যাপার।’
গুইমারা উপজেলার বাসিন্দা আবদুল জলিল বলেন, ‘এই পরিবহন খুবই বেপরোয়া। যাত্রীদের কোনো কথারই তোয়াক্কা করে না তারা। ড্রাইভার ও স্টাফসহ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বেশিরভাগই উগ্র মেজাজী। যাত্রীদের সাথে তাদের অসদাচরণ নিত্যদিনের ঘটনা।’
সজীব আহমেদ নামে জেলা সদরের আরেক যাত্রী বলেন, ‘চেয়ারকোচ বাস হওয়া সত্ত্বেও ট্রাকের মতেই মালামাল নেয়া হয় এই পরিবহনে। যাত্রীদের সাথে কোনো পণ্য থাকলে তার জন্যেও জোরপূর্বক ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে তারা।’
খাগড়াছড়ি আদালতের আইনজীবী রামগড়ের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট কবির হোসাইন বলেন, ‘এসব মূলত সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপেরই সমস্যা। তাদের একটি শক্ত কমিটি নেই যে- যারা ড্রাইভার, স্টাফ ও মালিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়ার সাহস রাখে।’
গ্রীন লাইন পরিবহনের সেন্ট্রাল জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমরা খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাত্রীসেবা চালু করতে চেয়েছিলাম। প্রায় দেড় বছর আগে জেলা আরটিসি কমিটি অনুমতিও দিয়েছিল। তবে খাগড়াছড়ি পরিবহন মালিক গ্রুপের নানামুখী বাঁধার কারণে এখন পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’
খাগড়াছড়ি সদরের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) সুপ্রিয় দেব বলেন, ‘শান্তি পরিবহনের যে সকল গাড়ি খাগড়াছড়ি রুটে চলাচল করছে তার মধ্যে কিছু সংখ্যক গাড়ির ফিটনেস নেই। চলতি বছরে ফিটনেস, রুট পারমিট ও টেক্স টোকেন সংক্রান্ত অসঙ্গতির কারণে শান্তি পরিবহনের বাস ও চালকদের বিরুদ্ধে ত্রিশটিরও বেশী মামলা করা হয়েছে।’
খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ এর সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় দাশ বলেন, ‘এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পরিবহনে কিছু সংকট ও সমস্যা আছে। যাত্রীদেরও কিছু অভিযোগ, অনুযোগ রয়েছে। তবে চাইলেই একদিনে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। আমাদের কমিটি দায়িত্ব নিয়েছি এখনো এক বছরও হয়নি, এরমধ্যে কিছু সমস্যার সমাধান করেছি। এছাড়া নতুন করে আরও কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন- ফিটনেস না থাকায় শান্তি পরিবহনের ৬০টি বাস আমরা সড়কে তুলছিনা। নতুন চেসিস ছাড়া কোনো বাস-ও এখন আর সমিতিতে অন্তর্ভুক্ত করছিনা। পাশাপাশি চালক-শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আচরণগত শালীনতা আনতে প্রথম ধাপে ৫০ জনকে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। শীঘ্রই তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) খাগড়াছড়ি সার্কেলের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘শান্তি পরিবহনের বেশিরভাগ বাস-ই ঢাকা থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়া। তবুও সড়কের শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে এবং যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণের কথা বিবেচনায় রেখে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। পাশাপাশি চালক, শ্রমিক ও পরিবহন মালিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর চালকদের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেসব চালকরা মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন তাদের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে না।’
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক ও জেলা আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির সভাপতি মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ‘সড়কের দুর্ঘটনাসহ সার্বিক বিষয়ে গত আরটিসি সভায় আলোচনা হয়েছে। পর্যটন নগরী হিসেবে এখানে মানসম্মত ও নিরাপদ যাত্রীসেবা দেয়া প্রয়োজন। খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম রুটসহ অপরাপর রুটগুলোতেও সকল কোম্পানির বাস চলাচল করতে পারবে। এর আগে যে সকল পরিবহন কোম্পানি এসব রুটে বাস চলাচলের অনুমতি পেয়েছিল এবং যারা অনুমতির জন্য আবেদন করেছিল তাদেরকে শীঘ্রই এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হবে।
প্রতিবেদক- খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, দৈনিক খবরের কাগজ।