পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির দীর্ঘ ২৫ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু চুক্তির অনেকাংশ আজও অবাস্তবায়িত। ফলে পাহাড়ের পরিস্থিতি আজও অস্থিতিশীল রয়ে গেছে। রয়ে গেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বেড়েছে একাধিক আঞ্চলিক দল। এদের বিরোধ মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠে পাহাড়। অন্যদিকে চুক্তির আলোকে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতায়ন না হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় স্থানীয়দের দাবী পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার স্থায়ী সমাধান আসেনি।
চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন না হওয়ায় তৈরি হচ্ছে নানামুখী সংকট। এসব থেকে উত্তোরণে অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণবাস্তবায়নের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান জরুরি বলে মন্তব্য অভিজ্ঞ মহলের।
পাহাড়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানের জন্য সরকার ও আন্দোলনকারী দল জেএসএসের মধ্যে দীর্ঘ সংলাপ শেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক এ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়।
এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের পক্ষে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
পার্বত্য চুক্তির ২৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
এ উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও জন সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া আলোচনা সভার আয়োজন করেছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং জেলা আওয়ামী লীগ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শর্ত মোতাবেক জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমাসহ ১৭০০ জন সদস্য সরকারের নিকট অস্ত্র সংবরণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। ভারতে আশ্রয় নেওয়া উপজাতীয় শরনার্থীরা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, উপজাতীয় শরনার্থী পুনর্বাসন টাস্কফোর্স, পার্বত্য ভূমি কমিশন এবং তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
এছাড়া পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে রাস্তাঘাট, সেতু, শিক্ষা, ধর্মীয়, সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়নের গতি আসে।
অর্থনৈতিকসহ সবক্ষেত্রে জীবনমানের অনেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনও আসে। কিন্তু দীর্ঘ পঁচিশ বছরেও চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন না হওয়ায় পরিস্থিতি জটিলতার দিকে মোড় নিতে থাকে।
ফলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফেরেনি। স্থায়ত্বি সমাধান আসেনি রাজনৈতিক সমস্যার। পাহাড়ে বন্ধ হয়নি রক্তপাত, হানাহানি।
অন্য দিকে সংবিধানের সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তির সাংঘর্ষিক ধারাগুলোর সংশোধনীর দাবি করছে বাঙালিভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ।
তারা বলছেন, পার্বত্য চুক্তিসহ কিছু বৈষম্যমূলক আইন পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মাঝে বৈষম্য তৈরি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে এসব আইন সংশোধন করতে হবে সরকারকে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিরাজ করছে স্থবিরতা। ফলে পাহাড়ের পরিস্থিতি জটিলতার দিকে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিরোধ চলছে জেএসএসসহ একাধিক আঞ্চলিক দলের। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর সংঘাতে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ছয় শতাধিক মানুষ। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন নিয়ে আজও হতাশায় পাহাড়ের মানুষ।
সরকারি দল বলছে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাকি অংশ বাস্তবায়নাধীন।
জনসংহতি সমিতির দায়িত্বশীলরা বলছেন, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম (উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসহ জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে সংগতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনগুলো সংশোধন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়নি।
তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর হয়নি।
এদিকে পার্বত্য চুক্তির চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো এখনও অবাস্তবায়িত। যদিও সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে এরই মধ্যে ৪৮টির বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়নাধীন।