কাপ্তাই উপজেলার পাহাড়ের চূড়ার স্কুল পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়। চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল থেকে বিদ্যালয়ে যেতে হলে চলতে হয় পাহাড়ী দীর্ঘ পথ। যে পথে বর্ষাকালে চলতে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের। সেই বিদ্যালয় থেকেই এইবার বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে মোহাম্মদ ইস্কান্দর।
বুধবার (৩০ নভেম্বর) সকাল ১১ টায় পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কথা হয়, ইস্কান্দর এর সাথে। সেই জানান, তাঁর জীবনের নানা সংগ্রামের কাহিনী।
ইস্কান্দর এর পিতা মোঃ জানে আলম রাঙ্গুনিয়া উপজেলার জঙ্গল দহ্মিণ নিশ্চিন্তাপুর ২নং হোছনাবাদ ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড এর চন্দ্রঘোনা খামার এলাকার নিতান্ত দরিদ্র কৃষক। জানে আলমের ২ ছেলে, এক মেয়ে। ৬ জন বিশিষ্ট পরিবারের ভরনপোষণ যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা, সেই পরিবার হতে দারিদ্র্যকে পেছনে ঠেলে তাঁর পরিবারের মেঝ ছেলে ইস্কান্দার এর জিপিএ ঃ ৫ অর্জনে স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী, পরিচালনা কমিটির সদস্য ও পাড়াবাসী অনেক খুশি।
ইস্কান্দার জানান, বাবার কৃষিকাজে সাহায্য করার জন্য এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়েও খুব সকালে ধান কেটেছে সে। গরু পালন, ধান রোপন, চাষাবাদ, ধান কাটা সব বাবার সাথে নিজেই করে সে। প্রতিদিন সকালে গরুর জন্য ঘাস কেটে এরপর স্কুলে আসতো সে। নিজ বিদ্যালয়ে সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে সেই অনেক জনপ্রিয়।
কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে ৪২তম জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় তার তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজিং প্রজেক্ট উপজেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকারের পর রাঙ্গামাটি জেলা পর্যায়েও তৃতীয় স্থান লাভ করে। সর্বশেষ ৪৪তম বিজ্ঞান মেলায় তারই তৈরি প্রজেক্ট উপজেলায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এছাড়াও, কাপ্তাই নৌ স্কাউটের লিডার হিসেবে কাপ্তাইয়ে স্কাউট পরিবারে সে এক পরিচিত মুখ। কালো চেহারার ছিপছিপে গড়নের ছেলেটি পড়াশোনা, স্কাউটিং এবং বিদ্যালয়ের কো-কারিকুলার কার্যক্রমগুলো করে গেছে কঠিন দারিদ্রতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে সেই আরোও জানায়, বাবার একার সংসারে ভালো করে ভরনপোষণই জোটে না। তাই আমরা দুই ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে কায়িক শ্রমে সাহায্য করি। খুব ভোরে উঠে ঘাস কাটা, ধান চাষের সকল কার্যক্রম আমরা তিনজনই করি। বর্তমানে নিত্যপণ্যের যেই দাম তাতে বাইরের লোক রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই কৃষিকাজ করেই নিজের পড়াশোনা নিজেরাই চালিয়ে যাচ্ছি।
তাঁর বাবা কৃষক মোঃ জানে আলম জানান, আমার মেঝ ছেলে ইস্কান্দর। সেই পড়তে খুব ভালোবাসে। আমাকে বলেছিলো সে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। আমি গরীব কৃষক। তাই ছেলের স্বপ্নকে ভেবেছিলাম অসম্ভব। কিন্তু আমার ছেলে এ+ পাওয়ায় আমি খুব খুশি। এখন আমি প্রয়োজনে জায়গা বেচেঁ কিংবা গরু বেচেঁ হলেও ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। আজকে আমরা সবাই অনেক খুশি। সে আমাদের গর্ব।
পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অনিল কুমার নাথ জানান, ইস্কান্দর খুবই ভদ্র নম্র ছেলে। বিদ্যালয়ের সব কাজে সবার আগে সে উপস্থিত থাকতো। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই তাকে আদর করে। তাঁর এই ফলাফলে আমরা সবাই খুশি। এছাড়া আমাদের অন্য একজন ছাত্রী নাজমা আক্তারও জিপিএ-৫ পেয়েছে। নাজমা দাদীর বাসায় থেকে পড়ালেখা করছে। মা হারা মেয়েটাও দারিদ্রতাকে জয় করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এইছাড়া এইবছর আরিফা রহমান মীম ও এ+ পেয়েছে।
আসলে ভৌগোলিক কারনে আমাদের বিদ্যালয়ে প্রায় সবাই দরিদ্র, প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে। তাই এই বিদ্যালয়ের এমন ফলাফল আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।
পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্যদের সভাপতি ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াছ কাঞ্চন চৌধুরী জানান, ইস্কান্দর সহ এইবছর যারা আমাদের বিদ্যালয় হতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এবং যাঁরা বিভিন্ন পয়েন্ট পেয়ে উর্ত্তীণ হয়েছেন তাদেরকে অভিনন্দন জানাই। শত প্রতিকূলতার মাঝে তাদের এই ফলাফলে আমরা আনন্দিত।
প্রসঙ্গতঃ পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর ৩টি জিপিএ-৫ এসেছে। পাশের হার ছিলো ৮৫%। গত বছরও জিপিএ-৫ ছিলো দুটো। এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া বাকি দুইজন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী নাজমা আক্তার ও আরিফা রহমান মীম।