রাঙামাটির নানিয়াচরের চেঙ্গী নদীর উপর নির্মিত সেতুটি পাহাড়ে সবচেয়ে বড় সেতু। পাহাড়ের পদ্মা সেতু নামে পরিচিতি পাওয়া সেতুটি গত বছর ১২ জানুয়ারী উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এ সেতু নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ জনের অধিক ক্ষতিগ্রস্তকে এখনো ক্ষতিপুরণ দেয়নি জেলা প্রশাসন। ক্ষতিপুরণের জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের বারান্দায় ঘুরছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
২০১৭ সালে সড়ক জনপদ বিভাগের ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য ১০.২মিটার প্রস্থের ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতুটি নির্মাণ কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
কাজ শুরুর আগে ক্ষতিপুরণ প্রদানের কাজ শেষ করার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।
তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া তথ্যমতে, সেতু নির্মাণে ৫ দশমিক ৫৬২৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হয়। যার ক্ষতিপুরণ মূল্য ১২ কোটি ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬২ টাকা।
এছাড়া অবকাঠামো, গাছপালার ক্ষতিপুরণ ধরা হয় ৪৬ কোটি টাকা ১১ লাখ ৫১ হাজার ১৯৭ টাকা। এ টাকাগুলো এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের বিতরণ করা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাজ শুরুর আগে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি না করায় ৫০ জনের অধিক ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা থেকে বাদ পড়েন।
অন্যদিকে চারটি প্রতিষ্ঠানের ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও এদের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যে ভূমির মূল্য ৬ কোটি ৫০ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ টাকা।
এ বিষয়টি নজরে আসলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা জানতে তদন্ত করে জেলা প্রশাসন। সড়ক বিভাগের প্রকৌশলী মো. আবু মুছা, সার্ভেয়ার ফয়েজুল আলম, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এল এ শাখার কানুনগো সুব্রত চাকমা, সার্ভেয়ার মো. খোরশেদ আলম, সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি এ তদন্তের কাজটি করেন।
তদন্ত শেষে এ কমিটি ১৮ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে। এদের ভূমি ক্ষতি হয়েছে ১ দশমিক ৪১ একর। যার ক্ষতিপুরণ মূল্য ১ কোটি ৬১ লাখ ৭ হাজার ২০ টাকা।
অন্যদিকে নানিয়াচর হার্টিকালচারের ১০ শতক, নানিয়াচর উপজেলা স্বাস্থ্য কম্প্লেক্সের ২০ শতক, মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের ১০ শতক এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ৪০ শতক অধিগ্রহণের তালিকায় থাকলেও এদের জমি ব্যবহারই করা হয়নি। যার ক্ষতিপুরণ মূল্য ২ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার। এগুলো বিতরণ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তথ্য দেয়নি জেলা প্রশাসন। গোপনীয় তথ্য বলে তথ্য প্রদান এড়িয়ে যায় জেলা প্রশাসন।
চিহ্নিত ১৮ জনকে ক্ষতিপুরণ প্রদানে ব্যবস্থা নিতে ২০২২ সালে ৫ এপ্রিল সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোসলেহউদ্দীন চৌধুরী রাঙামাটি জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়। কিন্তু কাউকে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়নি আজও।
বড়াদম মৌজার সোনাতি রঞ্জন চাকমা (৭০) বলেন, আমার ১ একর ভূমি সড়ক নিয়েছে। ক্ষতিপুরণের জন্য গত ৩ বছর ধরে ডিসি অফিসে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। ক্ষতিপুরণ না দিয়ে হাইকোর্টে যেতে বলেছে এডিসি। আমার মত আরো অনেকে আছে।
নানিয়াচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাপ্পী চাকমা বলেন, ক্ষতিপুরণ ছাড়া সেনাবাহিনী ও সড়ক জনপদ বিভাগ মিলে তড়িঘড়ি আমাদের বাড়ি ভেঙে দেয়।
পরে জেলা প্রশাসন আমাদের ক্ষতিপুরণ ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণ করে এ টাকা ডিসি অফিস থেকে গ্রহণ করতে নোটিশ দেয়। ডিসি অফিসে যাওয়ার পর এরা বলছে খাস জমিতে অবকাঠামোর কোন ক্ষতিপুরণ দেবে না।
সেতুর কাজ শুরুর আগে সড়ক জনপদ বিভাগের ২০১৮ সালে ৫ ফেব্রুয়ারীর এক নথিতে বলা হয়, আইনে না থাকলেও সেতু ও এর এপ্রোচ সড়ক নির্মাণের কাজ দ্রুততার সাথে করার সার্থে খাস জমিতে স্থাপনা ও গাছপালা অপসারণে ক্ষতিপুরণ দেয়া যেতে পারে। এ নথি মতে ৭৯ লাখ ২৩ হাজার টাকার চেক রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ টাকা বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
নানিয়াচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা বলেন, সেতুটি নির্মাণে ৪১ জন ভূমির মালিক ক্ষতিপুরণ পায়নি। খাস জমির উপর অবকাঠামো ও গাছপালার ক্ষতিপুরণ পায়নি ২০ জন। স্বয়ং আমার অফিসের এক কর্মচারী ক্ষতিপুরণ পায়নি।
বর্তমানে ক্ষতিপুরণ কাজে দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এসএম ফেরদৌস ইসলাম বলেন, এ প্রকল্প অনেক আগে শেষ হয়েছে। নতুন করে ক্ষতিপুরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। এদের উচ্চ আদালতে যেতে হবে। এ প্রকল্পে আমার আগের কর্মকর্তারা কে কি করে গেছেন এ দায় আমি নেব না। যারা আগে এ দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেন। আমি কিছুই বলতে পারব না।
রাঙামাটি সড়ক জনপদে নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আলনুর সালেহীন বলেন, রেজিস্ট্রি জমির ক্ষতিপুরণ, রেজিস্ট্রি জমি ও খাস জমির উপর স্থাপনা গাছপালার ক্ষতিপুরণের সমস্ত টাকা জেলা প্রশাসনকে বিতরণের জন্য দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষতিপুরণ কেন দেওয়া হচ্ছে না সেটা আমার জানা নেই। আমার কাছে কয়েক জন ক্ষতিগ্রস্ত এসেছে। আমি তাদের ডিসি অফিসে যেতে বলেছি।
এ ব্যাপারে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বাদ পড়াদের বিষয়টি এডিসি রেভিনিউ জানবে। খাস জমিতে অবকাঠামো ও গাছপালা অপসারণের ক্ষতিপুরণ দেওয়া যাবে কিনা এ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে চিঠি লিখেছি। তারা অনুমতি দিলে আমরা ক্ষতিপুরণ দেব।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং বলেন, সেতু সির্মাণে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপুরণ পাচ্ছে না এটা আমার জানা নেই। এটা হবার কথা নয়। কেন পাচ্ছে না তারা আমার কাছে আসলে আমি সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলব।