কিভাবে শুরু করি আর কিভাবে বিশদ লিখি, বুঝে উঠতে পারছি না। মেকি এই সমাজে সোকল্ড ভালো মানুষ আর প্রকৃত মানুষের তফাৎ করা দায়। কি জানি আমি এই দুই ধাঁচের মানুষের মধ্যে সহজেই কাছে টেনে নিতে পারি প্রকৃত ভালো মানুষদের। মেকি মানুষদেরও দূরে ঠেলে দেই না।
এমন এক প্রকৃত মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো দুই দশকের কাছাকাছি সময়ে। তিনি তখন খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা ইউনিয়ন পরিষদ’র নির্বাচিত তরুণতম চেয়ারম্যান। অসাধারণ সুদর্শন- সৌম্য- বিনয়ী- মিতভাষী প্রিয় শাক্যমনি চাকমা, তার আগে ছিলেন; উদালবাগান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। বৃহত্তর মাইনী অঞ্চলে শাক্যদা অজাতশত্রু। তিনি এমনই এক বিরল মানুষ জনপ্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব শেষে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনে তিনি খন্ডকালীন শিক্ষকতাকেই আবারো পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। নিজের মেধাকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে নীরবে তিনি কয়েক প্রজন্মকে এগিয়ে দেয়ার সাধনা অব্যাহত রেখেছেন। নিভৃতচারী এই মানুষটির জীবনে রাজনৈতিক পদ-পদবী’র অনেক অফার ছিলো। তিনি সেসব গ্রহণ না করে নিজের স্বাধীন সত্ত্বার সাথে লড়ে চলেছেন নিজের জনপদের শিক্ষা বিস্তারে।
আজ মধ্য দুপুরে তাঁর প্রিয়তম ছোট কন্যা পূর্বাশা চাকমা, অকাল মৃত্যুবরণ করেছে। গেলো সাত নভেম্বর পূর্বাশার জন্মদিন ছিলো। ওরা তিন বোন খুব হাসিখুশি ছিলো। সবাই বাবার মতোই নম্র-ভদ্র এবং সহিষ্ণু।
কোন একসময় আমরা চট্টগ্রামের সমাজ হিতৈষী এক অগ্রজকে সাথে নিয়ে বাঘাইছড়িমুখ এলাকায় একটি প্রতিবন্ধী আশ্রয় কেন্দ্র (আবাসিক) পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলাম। সেই সূত্রে শাক্যমনি চাকমাসহ উদালবাগান এলাকার বেশ কয়েকজন সমাজকর্মীর সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
শাক্যমনি চাকমা’র উদালবাগানের বাসায় আমি যে তখন কতো দিন কতো রাত ছিলাম ঠিক মনে করতে পারছি না। ওই পরিবারের প্রতিটি সদস্য এমনকি পোষা প্রাণির সাথেও আমার দারুণ সখ্যতা প্রতিষ্ঠিত।
খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ’র বিজ্ঞান শাখার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অকাল প্রয়াত পূর্বাশা চাকমা এবং তার বড়ো দুই বোন মিলে আমাকে কী পরিমাণ সম্মান-সমীহ করেছে; আমি কোনদিন সেই ঋণ শোধ করতে পারবো না। অলস প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় সব কাজেই তাদের ডাক পড়তো। নিজের বাবার আপন ভাইয়ের মতো করে রাতে ঘুমানোর পর উঁকি দিয়ে দেখতো মশারীটি ঠিকমতো টাঙানো হয়েছে, কী না।
আজ সেই সুকন্যার শেষের তারাটি খসে পড়লো বড়োই অকালে।
এই মেয়েটি হারিয়ে যাবার একটি মজার গল্পের সাথে আমার যুক্ততা আছে। একদিন শেষ বিকেলে আমরা রাতের খাবারের জন্য মাইক্রোযোগে উদালবাগান থেকে দীঘিনালা সদরে যাবো। ও তখন বাড়ির কাছের সড়কের পাশে সাথীদের সাথে খেলছিল। আমি তাকে বললাম, গাড়িতে উঠো। সাথে সাথে সে গাড়িতে উঠে পড়লো। আমরা দীঘিনালা থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আঁধার ঝেঁকে বসেছে। এদিকে পূর্বাশার বাড়িতে ফেরার কোনই খবর নেই। চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। কোথাও কোন সুখবর নেই। বাসায় ওর মা-বাবা এবং অন্যরা ভীষণ বিষন্ন। মোবাইল প্রযুক্তির যুগেও তাঁরা ভাবতে পারেননি যে, একটি শিশুকে মা-বাবার অজান্তে আমরা বাজারে নিয়ে গিয়ে নিশ্চিন্তে বেড়াতে পারি!
আজ, সত্যি সত্যিই কন্যাসম- মেধাবীমুখ পূর্বাশা চাকমা অকালেই হারিয়ে গেলো। তার অসমাপ্ত জীবনের অব্যক্ত গল্পগুলো আর কখনো শোনা হবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি অনেক বিষয়ে সরব হলেও আজ বড়ো বিলম্ব হলো। কী এক অস্বস্তিতে বদ্ধ ছিলাম। প্রিয় শাক্যমনি চাকমা দাদার নিদারুণ এই দু:সময়ে আমি যেতে পারিনি। কাল দুপুরের পর তাঁর প্রিয়তম মেয়ে পূর্বাশার মরদেহ ধর্মীয় নিয়মে দাহ হবে।
মহান সৃষ্টিকর্তা ভালো মানুষদেরই বেশি কষ্ট দেন। ধর্মে আছে, ‘এটি, বিশ্বাসের দৃঢ়তার পরীক্ষা। তিনি (ঈশ্বর) যা করেন, তার প্রতি নতশির হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। প্রিয় শাক্যদা- বৌদি-পুস্পাঞ্জলি-প্রত্যাশা এবং সকল স্বজনকে মহান দয়াল শোক বহনের শক্তি দিন।
মহান রব, তুমি কন্যাসম পূর্বাশার আত্মাকে পরম শান্তি দান করুন।