রাঙামাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করতে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন হয়। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের ২৬ বছরে পাহাড়ের সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন হলে নিশ্চিত হয়নি এ এলাকার মানুষের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারীত্ব।
যেটার জন্য সংগ্রাম দুই যুগেরও বেশী স্বশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসহংহতি সমিতি। পাহাড়ে অন্যতম প্রধান সমস্যার মধ্যে ছিল পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ভূমি বিরোধ।
কিন্তু চুক্তির ২৬ বছর পরও একটির বিরোধও নিষ্পত্তি করতে পারেনি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে প্রনয়ন হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। ২০১৬ সালে এটি সংশোধনের পর বিরোধযুক্ত জমি মালিকানা দাবী করা ব্যক্তির কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ করে কমিশন। তিন পার্বত্য জেলায় অবস্থিত তিনটি কার্যালয়ে প্রায় ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু পার্বত্য নাগরিক পরিষদের বাঁধার মূখে এ কাজ স্থবির হয়ে আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা না হলে তারা কমিশনকে কাজ করতে দিবেন না। এ আইনে কমিশন কাজ করলে পার্বত্য বাঙালীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে পার্বত্য চুক্তির ফলে সৃষ্ঠ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষও জেলা পরিষদের হচ্ছে না নির্বাচন। এ মুল বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ি বাঙালী উভয় জনগোষ্ঠীর মাঝে জমে আছে অসন্তোষ।
এমন অবস্থায় নানান চুক্তির ২৬ বছর পূর্তিতে কর্মসূচি পালন করছেন পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলো। জেলা পরিষদও পৃথক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। জন সমাবেশের আয়োজন করেছে জেএসএস।
চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ এ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারীত্ব নিশ্চিত করা। পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে সংরক্ষণ করা। পার্বত্য জেলার বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় গঠন হয়। কিন্তু চুক্তির ২৬ বছর পরও জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
রাঙামাটির সিনিয়র আইনজীবী সুস্মিতা চাকমা বলেন, চুক্তির ২৬ বছর পুর্তিতে এসে পাহাড়ের মানুষকে এখনো চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী জানাতে হচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ে চুক্তির অনেকগুলো বাস্তবায়ন হলেও বাস্তবায়ন হয়নি অনেকেগুলো মৌলিক বিষয়। তারমধ্যে জেরা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন না দেওয়া, অকার্যকর পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। পাহাড়ের আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় গঠন করা হয়নি মিশ্র পুলিশসহ একাধিক মৌলিক বিষয়। এগুলো না হওয়ায় পাহাড়ি বাঙালী সবাই চুক্তির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিএনপি রাঙামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ মামুন বলেন, চুক্তির ফলে গঠিত জেলা পরিষদের কাঠামো যথাযত হয়নি। এখানে পাহাড়িদের একক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান পাহাড়ি হবে ঠিক আছে। যদি ভাইস চেয়ারম্যান বাঙালী রাখা হত তাহলে পরিষদের ভারসাম্য যথাযত হত। তাই জেলা পরিষদের কাঠামো পরিবর্তন করা দরকার।
রাঙামাটি জজ কোর্টের আইনজীবী হারুনর রশীদ বলেন, চুক্তির ২৬ বছর ধরে জেলা পরিষদগুলো নির্বচন বিহীন। হচ্ছে না আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনও। এখানে পাহাড়ি কিংবা বাঙালী সাধারণ মানুষের কোন অংশগ্রহণ বা অংশীদারিত্ব নেই। আমরা চাইলেও সেখানে জনপ্রতিনিধি হতে পারছি না। ভোটও দিতে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ে হতাশা বঞ্চনা থাকবে।
রাঙামাটি জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজীব চাকমা বলেন, চুক্তির পর পাহাড়ে অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে সেটা ঠিক কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের সাথে এটার কোন সম্পর্ক নেই। উন্নয়ন করা সেটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বরং দেশে অন্যান্য অঞ্চলে যা উন্নয়ন হয়েছে তা পার্বত্য এলাকায় হয়নি। চুক্তির মূল বিষয়, ভূমি, পুলিশ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বেসামরিকীকরণ এগুলো হয়নি। ফলে এখানে সমস্যা জিইয়ে আছে। এতে সমস্যা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। চুক্তি যত দ্রুত বাস্তবায়ন হবে তত মঙ্গল।
সরকারের সাথে চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষ জেএসএস বলছে তারা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী করতে করতে হয়রান। তবুও ভরসা রাখতে হচ্ছে বর্তমান সরকারের উপর। জেএসএস কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি উষাতন তালুকদার বলেন চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী করতে করতে হয়রান হয়েছি। আমাদের যেন আর বলতে না হয়। সরকারের কাছে দাবী রাখব এ এলাকার শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকারের চুক্তি বাস্তবায়ন করা জরুরি।
সরকার দলের নেতারাও স্বীকার করছেন পার্বত্য চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করা দরকার। চুক্তির অনেকগুলো বিষয় বাস্তবায়ন হলেও মুল বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে শক্তিশালী হতে পারছে না পার্বত্য চুক্তির ফলে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
রাঙামাটি আসনের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন চুক্তির মুল বিষয় বাস্তবায়ন হয়নি এটি একেবারে সঠিক। এখানে নির্বাচন না হওয়ার কারণে চুক্তির ফলে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোন জবাবদিহিতা নেই। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মিশ্র পুলিশ গঠনের কাজটি হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়নটা দরকার। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের ২৬ বছরে এ এলাকার অব কাঠামো উন্নয়ন হলেও প্রতিষ্ঠা হয়নি স্থায়ী শান্তি। চুক্তিকে পুজি করে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক আঞ্চলিক সংগঠন।