রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ২ নং রাইখালী ইউনিয়ন এর রাইখালী বাজারে বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলিপ কুমার দাশ। ৭৩ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে ১ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছিলাম। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে তিনি অনেক বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। দেশ মাতৃকার বন্ধনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এক বিন্দু জন্য যুদ্ধের ময়দান হতে পিছপা হন নাই। যুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালে কিছুদিন তিনি বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি করলেও পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে তিনি নিজ জন্মভূমি রাইখালী বাজারে ছোট্র একটা বিস্কুট এর বেকারির দোকান দেন। বর্তমানে তাঁর ছেলে মেয়েরা বড় হওয়ায় ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন।
শনিবার (২৩ মার্চ) সন্ধ্যায় রাইখালী বাজারস্থ তাঁর বাসভবনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এই সময় তিনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনান।
মুক্তিযোদ্ধা দিলিপ কুমার দাশ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। ১ নং সেক্টরের অধীনে আমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।
যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স ১৯। তখন আমি নারানগিরি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছি। যদিও তখনকার সময়ে বেশি বয়সে আমরা প্রাইমারি স্কুল শুরু করেছি। যুদ্ধ শুরু হবার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমি আমার মা হতে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য প্রথমে রাজস্থলী বাজারে আমার মামার খামারে যাই। যুদ্ধের আগে কিন্তু আমার বাবা মারা যান। রাজস্থলী বাজারে মামার খামারে ২ দিন থাকার পর আমি সহ শতাধিক শরনার্থী ফারুয়া বর্ডারে ইন্ডিয়া জারুলছড়ি ক্যাম্পে আশ্রয় নিই।
তারপর ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী আমাদেরকে মিজোরামের কচুছড়ি ক্যাম্পে এরপর পানছড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এখানে কয়েকদিন থাকার পর মিজোরাম এর দেমাগ্রীতে যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য ক্যাম্পে অবস্থান করি। যেটা ১ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। সেখানে আমি ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী অধীনে ৩ মাস ট্রেনিং নিই। পরে আমাদের ১শত ৫০ জনের ট্রেনিং প্রাপ্ত একটা দলকে আসামের মানিক্যাছড় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান হতে আমাদের ৭৫ জনের একটা দলকে কুড়িগ্রামে পাঠানো হয়। জুলাই এর মাঝামাঝি আমরা যখন কুড়িগ্রাম মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান নিই,তখন কুড়িগ্রামে কোন পাক বাহিনীর সৈন্য ছিল না।
আগস্টের শুরুতেই একদিন রাতে পাক হানাদার বাহিনী অর্তকিত এসে কুড়িগ্রামে আমাদের ক্যাম্পে হামলা করে। তাৎক্ষণিক আমরা শুধুমাত্র রাইফেল আর হেন্ড গ্রেনেড নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। রাত ১০ টা হতে ভোর ৪ টা পর্যন্ত পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেদিন পাক বাহিনীর ছোঁড়া গ্রেনেড আমার হাতে লেগেছিল, আমার কানের পাশে কয়েক রাউন্ড গুলি চলে গেছে । মৃত্যুকে নিশ্চিত যেনেও আমরা পিছপা হয় নাই। অনেক পাক সৈন্য সেদিন নিহত ও আহত হয়েছিল। সেদিন তাঁরা পিছপা হটে। এরপর থেকে কুড়িগ্রাম আবারও আমাদের দখলে চলে আসে। পরবর্তীতে নভেম্বর এর দিকে আমাদের দলটি সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে বৃহত্তর রংপুর বিভাগের উলিপুর উপজেলা মুক্ত করে,সেখানে স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন অবস্থান করি। পরবর্তীতে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকা হতে সদরঘাট গিয়ে জাহাজে করে আমরা চাঁদপুর আসি। চাঁদপুর হতে এরপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আমাদেরকে দলটিকে নিয়ে আসা হয়।
সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এনামুল হক আমাদেরকে ১০ দিনের ছুটি দিয়ে দেন এবং ভাটিয়ারি মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগদান করতে বলেন। ১০ দিনপর এই ক্যাম্পে যোগদান করার পর সেখানে গিয়ে দেখি চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়েছেন। কিছুদিন পর সেই ক্যাম্পে জেনারেল ওসমানী এসে আমাদেরকে ফুল দেন এবং শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন।
তিনি আরোও বলেন, বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট সম্মান দিয়ে আসছেন। আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা দেশের টানে যুদ্ধ করেছিলাম।