অস্তিত্বহীন প্রকল্পে কোটি টাকা বরাদ্দ, টেন্ডারে জালিয়াতি এবং নাবিক নিয়োগে অনিয়ম—এই তিনটি অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামে তিনটি পৃথক অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য—কোথাও প্রকল্প নেই, কিন্তু আছে কাগুজে বরাদ্দ। কোথাও আবার নথিপত্র জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে টেন্ডার।
রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে একটি ‘অস্তিত্বহীন’ উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদক রাঙামাটি কার্যালয় থেকে একটি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে দেখা যায়, প্রকল্পের কোনো বাস্তব উপস্থিতি নেই, নেই কোনো অফিস কিংবা কর্মী। শুধু বাজেট বরাদ্দ আছে কাগজে-কলমে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর মন্ত্রণালয় ‘মৌখিকভাবে’ বরাদ্দ স্থগিত করেছে। তবে এখন পর্যন্ত অর্থ হস্তান্তর হয়নি বলে দুদক নিশ্চিত করেছে। অভিযানের সময় সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে টিম।
দুর্নীতি মানেই তো সৃজনশীলতা, তাই না? পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যেন সেটা আবারও প্রমাণ করল। এ দেশে উন্নয়ন মানেই এখন কাগজে-কলমে গোলাপফুল ফোটানো, বাস্তবে ফাঁকা মাঠ—আর মাঠও বলতে কি, সেটিও কাল্পনিক! অভিযোগ বলছে, এমন একটি প্রকল্পে সরকার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে যার কোন অস্তিত্বই নেই। নেই মাঠে-মাঠে কোনো কাজ, নেই প্রকল্প অফিস, নেই কর্মী। আছে শুধু বরাদ্দ। বাহ, কী দারুণ কল্পনাশক্তি আমাদের কর্মকর্তাদের।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসার পর মন্ত্রণালয় ‘মৌখিকভাবে’ বরাদ্দ স্থগিত করেছে। কী আশ্চর্য! কাগজে বরাদ্দ, আর বাতাসে স্থগিতাদেশ! রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থাও এখন বোধহয় হোয়াটসঅ্যাপে চলে।
দুর্নীতি দমন কমিশন রাঙামাটি জেলা শাখার সহকারী পরিচালক আহামদ ফরহাদ হোসেন ও উপসহকারী পরিচালক সরোয়ার হোসেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অস্তিত্বহীন প্রকল্পের নামে বরাদ্দকৃত সরকারী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয় হতে আজ একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে এনফোর্সমেন্ট টিম রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিদর্শনপূর্বক অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে নথিপত্র সংগ্রহ করে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, অর্থ বরাদ্দে অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশে অর্থ বরাদ্দ স্থগিত রয়েছে। অভিযানকালে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, তবে বরাদ্দকৃত অর্থ এখনও প্রদান করা হয়নি মর্মে টিম নিশ্চিত হয়েছে। অভিযোগসমূহ বিস্তারিতভাবে যাচাইয়ের নিমিত্ত টিম কর্তৃক প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনাপূর্বক কমিশন বরাবর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
একই দিনে ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে পরিচালিত দ্বিতীয় অভিযানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একাধিক প্রকল্পে টেন্ডার প্রদানে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করা হয়। অভিযানকালে এনফোর্সমেন্ট টিম দৈবচয়নের ভিত্তিতে কয়েকটি প্রকল্পের নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে। সংগৃহীত রেকর্ডপত্র এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য পর্যালোচনায় সড়ক ও জনপথের বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডারে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (National Development Engineers) -এর কার্যাদেশ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জাল ও ভুয়া রেকর্ডপত্র দাখিলের অভিযোগের সত্যতা রয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়। জাল ও ভুয়া রেকর্ডপত্র দাখিলের শাস্তিস্বরুপ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর NDE-কে ৬ মাসের জন্য ডিবার (Debar) করেছে মর্মে টিম তথ্য পায়। এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযানকালে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ শেষে কমিশন বরাবর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।
তৃতীয় অভিযানে চট্টগ্রামের বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে স্বজনপ্রীতি, নাবিক নিয়োগে অনিয়ম এবং হয়রানির অভিযোগে চট্টগ্রাম-১ কার্যালয় থেকে দুদক একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। টিম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে কমিশনের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের এসব অভিযান আবারও প্রমাণ করে, সরকারি উন্নয়ন খাতের অনেক প্রকল্পে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব।