রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি ফারুয়া ও বড়থলি ইউনিয়নে প্রায় ৭০ টি গ্রাম এখনো বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে, নেই তেমন সড়ক যোগাযোগেও। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস এবং পাহাড় পর্বতে ঘেরা। মোট ইউনিয়নে মধ্যে সবচেয়ে জনসংখ্যায় বেশি ফারুয়া ইউনিয়ন। ফারুয়া ইউনিয়নে আয়তন ২৮০ বর্গকিলোমিটার এবং বড়থলি ইউনিয়নের আয়তন ২৭৮ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা অনুসারে এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী বেশি।
ডিজিটাল যুগে এসেও এখনো মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে রাঙামাটি বিলাইছড়ির ফারুয়া ও বড়থলি ইউনিয়ন। ফারুয়া ৫০ টি এবং বড়থলি ২০ টি গ্রাম। দুই ইউনিয়নে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি জনগণের বসবাস। মোবাইল ফোনে নেটওর্য়াক না থাকার ফলে ডিজিটাল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। শুধু ফারুয়া ইউনিয়নে প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২১টি। বড়থলিতে ৪ টি। সেখানে মোবাইল নেটওর্য়াক না থাকার কারণে তারা যুগের সাথে তাল মেলাতে পারেনা। বর্তমানে সব কিছু ডিজিটাল আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে, নাগরিক সেবা অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। যাতে প্রত্যেক নাগরিক খুব সহজে ঘরে বসে সেবা পায়। কিন্তু এই দুই ইউনিয়নের জনগণ এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
সরেজমিনে দেখতে গিয়ে দেখা যায়, দেশের সব চেয়ে বড় ইউনিয়ন এই ফারুয়া ইউনিয়ন। প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ এখানে বসবাস করছে। একইভাবে ফারুয়ার দক্ষিণে মায়ানমার ও ভারতের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় ৪০০০ জনসংখ্যা রয়েছে বড়তলি ইউনিয়নেও। এখানে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষদের দেখলে মনে হওয়ার কোনো অবকাশ নেই যে এরা বাংলাদেশের জনগণ। একেতো দুর্গম আর পশ্চাৎপদ এলাকা, অন্য দিকে মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ফলে দেখা যায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কৃষক তার ফসলি জমির যেকোনো সমস্যায় কৃষি বিশেষজ্ঞ কিংবা কৃষিসম্প্রসারণ কর্মকর্তার পরামর্শ পান না। সেক্ষেত্রে তাকে উপজেলা সদরে আসতে হয়।
দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, মোবাইল ফোন, ইন্টারেনট সেবা এখন পৌ্ছেঁ গেছে ঘরে ঘরে। অথচ কাল্পনিক মনে হলেও বাস্তব সত্য যে ফারুয়া ও বড় থলি এই দুই ইউনিয়নে মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। বিভিন্ন পরিস্থিতির সময় সারা দেশে প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে। এখানকার শিশুরা এই সেবা নেটওয়ার্ক থেকে বঞ্চিত। স্থানীয় অভিভাবকদের দাবী, তাদের সন্তানরা যেন জরুরি নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ এই সুবিধাটি পায়। এছাড়া প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও নেই মোবাইল নেটওয়ার্কের সুবিধা। সারা বাংলাদেশের মানুষ যেখানে ঘরে বসে ডিজিটাল সুবিধা পাচ্ছে, সেখানে এসব এলাকার ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনসাধারণ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
কৃষক / জুমিয়ারা জানান, জুম ও জমিতে উৎপাদিত ফলমূল ও শাকসবজি এবং মসলা জাতীয় পণ্য আদা, হলুদ দেশে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বিদ্যুৎ, নেটওয়ার্ক ও মূল সড়কের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধা না হওয়ায় ঠিকমত ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সংরক্ষণ এবং বাজারজাত করা যাচ্ছে না। যার ফলে নার্য্যমূল্য পাচ্ছি না, কোনো কোনো সময় পঁচন ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, সরকার চাইলে যে কোনো মুহূর্তে করতে পারে, এজন্য দরকার সকল প্রশাসনের সদিচ্ছা। অনেক কষ্টের মধ্যে আছি আমরা। এখানে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও মোবাইলে নেটওয়ার্ক নাই। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি পাওয়া এগুলো সব মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেগুলো আমাদের শিক্ষার্থীরা ঠিক মতো পাইও না জানেও না। অসুস্থ রোগীদের জন্য ঠিক মতো চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা নাই। অভিজ্ঞ ডাক্তারদের যে পরামর্শ নেব সেই সুযোগও নাই। বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক না থাকায় আমরা সরকারের নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তারা জানান, মনে হয় আমরা এদেশের জনগণ নই। সেজন্য সরকার আমাদের দেখতে পারে না। সরকার চাইলে এটা সমাধান করতে পারেন। এ বিষয়ে নেই কোনো সরকার ও কোনো প্রশাসনের সদিচ্ছা। এজন্য প্রয়োজন উপজেলা ও জেলার সকল প্রশাসন ও পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সুদৃষ্টি।
বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক জানান, নেটওয়ার্কের যতো ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা আছে তা আমরা পাচ্ছি না। বিদ্যালয়ের অফিসিয়াল কাজগুলো আমাদের বিলাইছড়ি অথবা পার্শ্ববর্তী উপজেলা রাজস্থলী এবং বান্দরবানে রুমা উপজেলায় গিয়ে করতে হয়। যা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। আমাদের নেটওয়ার্কের অসুবিধার কারণে এইসব যেতে হচ্ছে।
এলাকার হেডম্যানরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। দেশে প্রায় জায়গায় সড়ক, নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ সুবিধা উন্নতি করা হচ্ছে, করা হচ্ছে না আমাদের ইউনিয়নগুলো। স্বাধীনতার আগ থেকেই এই গ্রামগুলোতে বসবাস করে আসছে মানুষ। সরকার দেখেও না দেখার মতো রয়েছে।
ধর্মীয় গুরু/ পালক প্রধান রবার্ট বম জানান,উপজেলা ও শহরের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সবসয় রঙিন আলোতে ঝলমল করে। সেখানে গেলে রঙিন জগতে বসবাস করছে মনে হয়, কিন্তু নিজের জায়গায় আসলে মনে হয় ভিন্ন জগতে বসবাস করছি। আর ফারুয়ার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ডুকলে টর্চের আলো দিয়ে ডুকতে হয়। নেটওয়ার্ক তো নাই,নাই বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের কথা না হয় বাদ দিলাম।