সালাহ উদ্দিন, তার বাবা কবির আহমেদ ছিলেন কক্সবাজার কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির হিসাব রক্ষক। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর আগে তিনি মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর সহায়-সম্পদে ভরপুর সেই সমিতির হর্তা-কর্তা বনে যান ছেলে সালাহ উদ্দিন। তিনি সমিতির কোন কর্মকর্তা কিংবা সদস্য না হয়েও আওয়ামী লীগের তৎকালীন এক নেতার প্রভাব খাটিয়ে সমিতি ও সমিতির স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির দখল নিয়ে নেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, জেলা ও উপজেলা সমবায় কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে তিনি টানা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সমিতির সবকিছুতে লুটপাট চালাতে থাকেন। এমনকি সমিতির কার্যালয় ও বাংলোটি দখল করে নিজের পরিবারের বসতঘর বানিয়ে বসবাসও করে চলেছেন। সেই ঘরে সালাহ উদ্দিন তার মা ও দুই ভাই এবং তাদের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আলিশান ভাবে থাকছেন। সেই ঘরে লাগানো হয়েছে এয়ার কন্ডিশনার (এসি)। আর সমিতির সম্পদ ভাড়া দিয়ে প্রতিবছর আত্মসাত করছেন ৬ লাখেরও বেশি টাকা। প্রতিবছর মাত্র ৪২ হাজার টাকা আয় ও ব্যয় দেখিয়ে গেলো দশ বছরে আত্মসাত করেছেন ৫৫ লাখেরও বেশি টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, সালাহ উদ্দিন কক্সবাজার কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নিয়োগপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারি না হলেও নিজেকে কখনও সমিতির হিসাবরক্ষক, কখনও সভাপতি হিসেবে পরিচয় ও স্বাক্ষর করে ওই সংগঠনের সবকিছু আত্মসাৎ করছেন। সমিতির সর্বশেষ অডিট মতে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত গেলো এক বছরে সমিতির স্থাবর সম্পদ গুদাম ঘর, বাসা ভাড়া ও ওয়ার্কশপ ভাড়া দিয়ে আয় হয়েছে মাত্র ৪২ হাজার টাকা।
অথচ সমিতির সংশ্লিষ্টরা জানান, সমিতির স্থাবর সম্পদের মধ্যে ভাড়াযোগ্য ১১টি ঘর রয়েছে। যেগুলো ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে আয় হয় ৫০ হাজার ৯০০ টাকা। আর এই ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে জামানত হিসেবে সালাহ উদ্দিন নিয়েছেন ৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই সমিতির সম্পদ হিসেবে ৮০ ফুট দীর্ঘ একটি গুদাম ঘর, কয়েকটি ভাড়া বাসা, কোল্ড স্টোরেজ, ওয়ার্কশপ, ৬৫ ফুট লম্বা সমবায় বাজার, বরফ কল, সমিতির অফিস ঘর ও বাংলো রয়েছে। সালাহ উদ্দিন তৎকালীন ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার প্রভাব খাটিয়ে সমিতির সব সম্পদ দখল করেছেন। একই সাথে সমিতির অফিস ঘর ও বাংলো দখল করে সরকারি কোন অনুমোদন না নিয়ে কাঠের তৈরি স্থাপনা ভেঙ্গে পাকা স্থাপনা বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিজের পুরো পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। সমিতির সেই ঘরেই নিজের ও ভাইদের ২ জন স্ত্রীও ঘরে তুলেছেন। সেখানে লাগিয়েছেন অত্যাধুনিক এয়ার কন্ডিশনার। এছাড়াও সমিতির নামে আরও ভূ-সম্পদ থাকলেও সমিতির কর্মচারি কবির আহমেদের মৃত্যুর পর সবকিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন তারই ছেলে সালাহ উদ্দিন।
তানভির আহমেদ নামের একজন ভাড়াটিয়া জানান, পারটেক্সের কারখানার জন্য ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। টানা ৬ বছর তিনি এই কারখানা চালিয়েছিলেন। প্রথম ৫ বছর তিনি প্রতিমাসে ১০ হাজার হিসেবে ৬ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। শেষ বছরে তিনি প্রতিমাসে ১৪ হাজার টাকা হিসেবে এক লাখ ৬৮ হাজার টাকা ভাড়া দেন। কারখানার সেলামি হিসেবেও দিয়েছিলেন ৩ লাখ টাকা।
গিয়াস উদ্দিন নামের একজন ভাড়া নিয়েছিলেন সমিতির বরফ কল। প্রতিমাসে ৬ হাজার টাকা হিসেবে আড়াই বছর ছিলেন। তিনি ৬ লাখ টাকা সেলামিও দিয়েছিলেন। একই সাথে বরফ কলের মালামালের জন্য ৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা আলাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ওই বরফ কলে কোন মালামাল নেই। শূণ্য ঘরটি পড়ে আছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, সমিতির ভাড়াযোগ্য ১১টি ঘরের মধ্যে ফারুক আহমেদ ৬ হাজার টাকা, নুরুল হুদা ৩ হাজার টাকা, রশিদ আহমেদ (নাছির উদ্দিন) ৮ হাজার টাকা, শামসুল আলম ৩ হাজার দুইশত টাকা, মো. আজিজ ৪ হাজার টাকা, মো. সোলেমান দুই হাজার ৫০০ টাকা, নুরুল আবছার ৩ হাজার টাকা, নুরুল কবির এক হাজার দুইশত টাকা করে প্রতিমাসে ভাড়া উত্তোলন করা হচ্ছে। এখানে সালাহ উদ্দিন ও রোকন কবির রায়হানও দুটি দোকান নিজেরা আয়ত্বে রেখেছেন। এছাড়াও এদের কাছ থেকে ৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা সেলামি নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা ভাড়া তুললেও একটি টাকাও সমিতি পায়নি। বরং সর্বশেষ অডিটে দেখা গেছে, মাত্র ৪২ হাজার টাকা এক বছরের আয় দেখানো হয়েছে। অবশিষ্ট টাকা সালাহ উদ্দিন ও তার পরিবার আত্মসাত করেছেন। টানা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এই অবস্থা চলছে।
কক্সবাজার কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সর্বশেষ নির্বাচিত কমিটি ছিল ২০১৫ সালে। ওই বছর ১০ মে তারিখে নির্বাচন দেখানো হয়। সভাপতি নির্বাচিত হন পূর্ব গোমাতলী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য মোসলেম উদ্দিন। আর সম্পাদক নির্বাচিত হন কুলালপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য সোলতান আহমদ। চার সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির পর আর কোন নির্বাচন হয়নি এই সমিতির। সমবায় কার্যালয় থেকে তিন দফায় সমবায় কার্যালয়ের পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে সভাপতি করে অন্তর্বর্তীকালিন ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে দেয়া হলেও কোন কমিটিই দায়িত্ব নিতে পারেনি। সালাহ উদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রভাববলয় ব্যবহার করে কোন কাগজপত্রই অন্তর্বর্তী কমিটিকে সরবরাহ করেননি। যে কারণে, অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতিরা দায়িত্বভারও গ্রহণ করতে পারেননি।
সর্বশেষ অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতি ছিলেন সমবায় কার্যালয়ের পরিদর্শক দিদারুল ইসলাম। তিনি বলেন, সালাহ উদ্দিন নামের ওই ব্যক্তি কাগজপত্র সরবরাহ না করায় এবং সমিতির সদস্যদের সহযোগিতা না পাওয়ায় অন্তর্বর্তীকালিন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেয়া সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের কমিটির মেয়াদ ছিল ১২০ দিন। এ সময়ের মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করতে না পারায় সেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
সর্বশেষ নির্বাচিত কমিটির সভাপতি মোসলেম উদ্দিন জানান, সালাহ উদ্দিনের বাবা ছিলেন সমিতির কর্মচারি। তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছেলে সালাহ উদ্দিন সমিতির সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। যদিও তিনি সমিতির নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ নন।
তিনি জানান, সমিতির সদস্য সমিতির সংখ্যা কাগজে-কলমে ৬৬ হলেও বাস্তবে সমিতি ছিল মাত্র ৮টি। একটি কেন্দ্রীয় সমিতি গঠন করতে কমপক্ষে ১০টি সমিতি লাগে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে সমবায় অফিসের অডিট চলছে। এই মুহুর্তে সমিতির কোন কমিটি নেই। আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে সমিতির দেখাশোনা করছি।
তিনি বলেন, সমিতির অফিস ঘরটি জবরদখল হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেওয়ায় প্রায় ১৫ বছর আগে স্থায়ী ঘর ছেড়ে আমার বাবা কবির আহমেদ সবাইকে নিয়ে এখানে উঠেছিলেন। ঘরটি এখনকার মতো ছিল না। সামাজিকতার কারণে ঘরটি কিছুটা মোডিফাই করা হয়েছে।
তিনি অবশ্য সমিতির সম্পদ ও টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অস্বীকার করেন। যদিও তিনি সামাজিক শক্রতার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে দাবি করেন।
কক্সবাজার জেলা সমবায় কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল জানান, তিনি নতুন এসেছেন। এখনও পুরোপুরি বিষয়টি জানেন না। এ বিষয়ে অডিট রিপোর্ট দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।