স্বাধীন বাংলাদেশে সকল মহকুমাগুলোকে জেলাতে রূপান্তরিত করা হলেও একমাত্র রামগড়ের ভাগ্যে তা মিলেনি। জেলা সদর স্থানান্তর করা হয় খাগড়াছড়িতে। রামগড়ের অধীনে মহালছড়ি তার থানা হিসেবে যোগাযোগ, শিক্ষা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। মনে আছে, খাগড়াছড়িবাসীরা চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি যেতে মহালছড়ি হয়ে যেতো। আলুটিলা কেটে রাস্তা তৈরি হলে মহালছড়ির সীমানা কমতে শুরু করে।
এক সময়ের মহালছড়ির সীমানা বর্তমান লক্ষীছড়ি উপজেলা পর্যন্ত হলেও, কেটে নিতে নিতে সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নটিও গুইমারা উপজেলা নিয়ে নিয়েছে। মহালছড়ি উপজেলায় দুটি নেতৃত্বদানকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও আজ অবসরে।
তারা তাদের কর্মজীবনে স্কুল পরিচালনা করতে, চট্টগ্রাম পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে স্বল্প শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত শিক্ষকদেরই খুঁজে আনতেন। যাদের অনেকেই ছাত্রদের পাশে বসে সমস্যা শুনার বদলে বেতের বারি দিয়ে ঠান্ডা করার মনেবৃত্তি আর ভয় পাইয়ে প্রাইভেটের নামে টাকা কামাইয়ের কাজটি করতেন মাত্র। যদি নিজের জীবনে প্রভাব বিস্তারকারি একজন শিক্ষকের নাম বলতে বলা হয়, সেভাবে কারোর নাম উচ্চারিত হয় না। এটি শুধু আমার সমস্যা নয়, অন্য অনেকের বেলায়ও কথাটি সত্য হবে বলে আমার ধারণা।
মহালছড়ি গেলে কাগজপত্র, বই-খাতা কলম ও অন্যান্য স্টেশনারির প্রয়োজনে একটি দোকান থেকে কিনতাম। এবার দোকানটি থেকে কিছু কাগজ কলম কেনার শেষে জরুরি প্রয়োজনে একটি মোটা কাগজটিকে এক টুকরা কেটে দিতে অনুরোধ করলে বলে “এটা আমাদের কাজ নয়”। আমি বললাম “ঠিক আছে টেবিলে থাকা স্কেল দিয়ে একটু কেটে দেন”। আবার বলে “আমরা এই কাজটা করি না”। আমি আবার বললাম “করেন না ঠিক আছে, আমার জন্য একটু করে দেন, আমার জরুরি প্রয়োজন, যার কারনে অনুরোধ করছি”। বলে অন্য কোথা থেকে করে নেন”। এবার মনটা খারাপ হলো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুকে বললাম। সেও বলে “দোকানের ছেলেটি একটু —।” পরে উপজেলা ক্যান্টিনে গিয়ে অপেক্ষারত বন্ধুদের বললাম। তারাও বললো “আমাদেরকেও ছেলেটি বাজে ব্যবহার করে। ব্যবসা করে নিয়েছে। এখন লোকজনকে আর চোখে দেখে না।”
খোঁজ নিয়ে জানলাম, সিঙ্গিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন শিক্ষক স্টেশনারি দোকানটির মালিক। প্রথমে নাকি ফটোগ্রাফার রতনের সহায়তায় একটি ছোট দোকান দিয়ে শুরু করেছিল। বছর খানিক আগে স্কুল শিক্ষকটি নিজ ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযেগে এক প্রকার স্কুল থেকে বিতাড়িত হন [দেখুনঃ ইত্তেফাক ২৮ সেপ্টেম্বর, ২১; Banglanews24.com, ২৭ সেপ্টেম্বর ২১]। আর দোকানে থাকা যে ছেলেটি আমায় অপারগতা প্রকাশ করেছিল, তারই সুযোগ্য সন্তান। পরে আরো জেনেছি, সিঙ্গিনালা স্কুলে শিক্ষকতা করে চন্দনাইশ উপজেলায় দুতলা বাড়ি বানিয়েছে। মহালছড়ি উপজেলা সদরেও জায়গা কিনে দুতলা বাড়ি করেছে। মহালছড়ি বাড়িটির আর্বজনা পানির ড্রেনটি নাকি রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে রাখতো। পরে এলাকার মানুষের চাপে বন্ধ করতে বাধ্য হন। শিক্ষক তার স্কুল থেকে বিতাড়িত হলেও দোকানে ছেলেকে রেখে ক্রেতাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তার বিতাড়িত হওয়ার জ্বালা কিছুটা হলেও মিটাচ্ছেন। মাঝে সাঝে নাকি শিক্ষকটিও দোকানে বসেন।
শিক্ষক তার নিজ স্কুলের ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বিতাড়িত হলেও দোকানটি এখনো কিভাবে রমরমা ব্যবসা করতে পারে আমাকে ভাবিয়েছে। বিতাড়িত স্কুল শিক্ষকের ছেলে মহালছড়ি উপজেলার ছাত্র-শিক্ষকদের কিভাবে অবহেলা করতে পারে, আমাকে আহত করেছে। দোকানটি টিকে থাকার শক্তিতো আমরা ক্রেতারা। একজন ছাত্রীর অভিযোগে চাকরি চলে যাওয়া শিক্ষকের দোকানে কেন ভিড় করছি?
আমি এতদিন কিনেছি না জানার কারণে, আপনারা যারা মহালছড়িতে থাকেন, চিনেন তারা কিভাবে এই দোকান থেকে কিনতে পারেন?
মহালছড়ি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যিনি শুধু মারধর করতেন, প্রাইভেট পড়াতেন, আর হাটুর উপরে লুঙ্গি তুলে বাজারে ঘুরে বেড়াতেন। মাছের ব্যবসা করতে গিয়ে এমন এমন আচরণ করতেন, তার ছাত্র হিসেবে ভাবলে কষ্ট লাগে। এই সব করতে করতে বাজারে দোকান কিনে দালান তৈরি করেন। একজন শিক্ষকের যে নুন্যতম গুণ থাকা দরকার, কোনটি তার কাছে দেখি নি।
এখন চিন্তা করলে বুঝতে পারি, আমাদের স্কুল কর্তৃপক্ষ, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ, শুধু তাদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে অকেজো, নিম্ন মানের লোকজনকে শিক্ষকতা করতে এনেছিলেন। আমরা যে ক’জন টুকটাক পড়ালেখা করেছি সবই নিজেদের প্রচেষ্টায় নয়তো পারিবারিক কারণে। নিম্ন মানের শিক্ষকতার কারণে কত কত আমাদের সহপাঠী ঝরে পড়েছে, এখন হিসাব করলে অনুধাবন করতে পারি। আমাদের সময়ে নেতৃত্বদানকারি শিক্ষকগণ এর দায় এড়াতে পারেন কি?
নিম্ন মানের শিক্ষকতার কারণে ছাত্ররা শুধু ঝরে পড়েনি, চিন্তা-চেতনার দারিদ্রতায় নিমজ্জিত হয়ে মহালছড়ি তার ভার এখনো বহন করছে বলে মনে করি। মূল্যবোধের অভাবে এলাকার শিক্ষকরাও যুথবদ্ধ হয়ে যৌন হেনস্তাকারি শিক্ষকের দোকানটিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাতে পারেননি। আমরা কোন না কোনভাবে ছাত্রী হেনস্তাকারি, মাছ ব্যবসায়ি শিক্ষকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ছাত্রছাত্রী বলে আমাদের মাঝে আদর্শ শিক্ষক হওয়ার বাসনা, উচু মানের শিক্ষক হওয়ার তাড়না পোষণ করতে পারিনি। তাই উপজেলার বয়স বাড়লেও আদর্শ শিক্ষক, নীতিবান শিক্ষকের নাম তালিকায় নতুন কোন শিক্ষকের নাম নেই।
শার্ট-প্যান্ট পরা ক্রেতাদেরকেও যে দোকানদাররা দু’পয়সার দাম দেয় না, আর সেই কালা পাহাড় থেকে যারা ময়লা আর অল্প কাপড় নিয়ে মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, বেগুন বিক্রি করতে আসেন, তাদের প্রতি আমাদের মহালছড়ির দোকানদাররা কেমন ব্যবহার করতে পারেন, আমরা কিছুটা অনুমান করতে পারি। বাজার দিনে দোকনদাররা স্থানীয় বিক্রেতাদের কতভাবে অবমূল্যায়ন, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকেন, খারাপই লাগে। দোকানদাররা বুঝতে চায় না, তাদের বেচাবিক্রি করা টাকাতেই তাদের দোকানপাট চলে। তাদের ছেলেমেয়েরাই কোন না কোন স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং তারাই তাদের প্রধান ক্রেতা।
পাহাড়ে এটাও একটা দুঃখজনক যে, পাহাড়ে যত কিছু কাজ হয়েছে কোনটি স্থানীয় ফসল বিক্রেতাদের জন্য হয়নি। বাজারে যত শেড নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে, সবই বাইরের ব্যবসায়িদের দখলে গেছে। স্থানীয় বিক্রেতাদেরকে সম্মানের সহিত তাদের উৎপাদিত ফলমূল বিক্রয়ের সুবিধা দিতে জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড উল্লেখযোগ্য কিছুই করেনি। মহালছড়িতে চাল বিক্রেতাদের জন্য একটি শেড আছে, মাছ বিক্রেতাদের জন্যও একটি আছে। সবই বাইরের কিংবা বাজার ব্যবসায়িদের দখলে। যারা গ্রাম থেকে এসে বেচাবিক্রি করবেন তাদের জন্য কিছু কি রেখেছি? একমাত্র রাস্তাই তাদের সম্বল। তাদের উৎপাদিত পণ্য/ফসল বিক্রি করতে হয় চরম অযত্ন অবহেলায়। বাজার দিনে গাড়িওয়ালারা পথে বসে থাকা বিক্রেতাদের বকা দেয়, রাগ ঝাড়ে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়দের জন্য কিছুই ভাবেনি। একইভাবে আমাদের স্কুলগুলোও আমাদের স্থানীয়দের জন্য কিছুই ভাবেননি বলে, সে রেশ এখনো আমাদেরকেই টেনে বেড়াতে হয়। ভোগ করতে হয়। নিজের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধের বদলে, গভীরভাবে চিন্তা করলে কষ্টই জাগে।
এসএসসি ৯২ ব্যাচের মারমা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থলিপাড়া ও মুড়াপাড়া থেকে ২ জন ছাত্র, চোংড়াছড়ি মৌজা পাড়া থেকে ৪ জন ছাত্র ও ৬ জন ছাত্রীর মধ্যে কেউ এসএসসি পেরোতে পারেনি। তারা সবাই ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে ৩জন মারাও গেছেন। এটি শুধু ১টি ব্যাচের ৩টি মারমা পাড়ার চিত্র। যদি দীর্ঘ কয়েক যুগের অর্ধ শতাধিক ব্যাচের, শতাধিক পাড়ার ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়ার হিসাব সামনে দাঁড় করানো যায়, পাঠককে অবাকই হতে হবে। এই সবই হয়েছে নিম্নমানের শিক্ষকদের দ্বারা স্কুলগুলো পরিচালিত হওয়ার কারণে। যে রেশ এখনো আমরা নানাভাবে বহন করেই চলেছি এবং প্রতিনিয়ত নানাভাবে মুখোমুখি হচ্ছি।
একজন চোর কিংবা একজন ডাকাত একজনের জীবন, একটি পরিবারের জীবন নিতে পারে মাত্র। কিন্তু একজন শিক্ষক তার গুরু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, সমাজকে তার ভার বহন করে বেড়াতে হয় দীর্ঘকাল।
মাছ ব্যবসায়ি শিক্ষক, যৌন হয়রানি করিয়ে শিক্ষকরা যদি শিক্ষকতা করার সুযোগ না পেতেন এলাকার প্রচুর ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পেতেন। যোগ্য শিক্ষকদের শিক্ষায় আমাদের মহালছড়িও আলোকিত হতো। আমরা নানাভাবে এগিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু, সে সুযোগ আমরা পাইনি।
মারমাদের একটি প্রবাদ আছে “ দেংবাং অক্ কা দেংজি য়ক্ তে”।
অথাৎ “দেংবাং ফুল গাছের নিচে, সে ফুলের চারাই গজায়”। আমাদের মহালছড়িও এখন সে অবস্থায় পরিণত হয়েছে। আমরা যেমন শিক্ষক পেয়েছি সে রকম ছাত্রই পাচ্ছি। শিক্ষকরা ছাত্রদের যেমন আচরণ করতেন, সে ছাত্ররা সকলকে সে আচরণই করছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ঠকিয়েছে। যৌন হয়রানির অপরাধে চাকরি হারানো শিক্ষক নামধারি দোকান থেকে কেনা-কাটা করতে গিয়ে আবার অপমানিত হতে চাই না। আমাদের সময়ে আমরা বাইরের যে সকল শিক্ষকদের পেয়েছি, অধিকাংশই ‘ব্যবসায়ি’। তারা আমাদের মহালছড়িকে কিছুই দিতে আসেননি, নিয়ে গিয়েছেন মাত্র। আমাদের সময়ে আমরা ছাত্ররা ঠকেছি। আমাদের একটি কাঠামোর মধ্যে দিয়ে ঠকানো হয়েছে। মহালছড়ি শিক্ষকরা, ছাত্র-ছাত্রীরা যৌন হেনস্তাকারি তথাকথিত স্কুল শিক্ষকের দোকান থেকে কেনাকাটা করুক, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি আর কোনকিছুই কিনছি না। এটা আমার শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীর প্রতি নির্যাতনের প্রতিবাদও।
-কলাম লেখক। ইমেইলঃ nyohlamong2@gmail.com