টানা বর্ষণে রাঙামাটিতে পাহাড়ধস ও বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের একজন পাহাড়ি স্রোতে ভেসে গিয়ে এবং অপরজন আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। এদিকে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা ও জানমালের ক্ষতি এড়াতে মাঠে তৎপর রয়েছেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। ঝুঁকিতে থাকা লোকজনের নিরাপদ আশ্রয়ে খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ঝুঁকিতে বসবাসকারী লোকজনদের পাঠানো হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার থেকে টানা চারদিন ধরে রাঙামাটিতে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে কাপ্তাই হ্রদে উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে প্রবল স্রোত বইছে। ইতোমধ্যে সম্ভাব্য দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি এড়াতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। এদিকে পাহাড়ি ছড়ায় প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়ে এক্কযেইয়া চাকমা (৮০) নামে এক বৃদ্ধের প্রাণহানি ঘটেছে।
স্থানীয়রা জানান, জেলার নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ধাজ্যাছড়া গ্রামের বাসিন্দা এক্কযেইয়া চাকমা শুক্রবার সন্ধ্যায় তার বড় ছেলের বাড়ি হতে ছোট ছেলের বাড়ি ফেরার পথে পাহাড়ি ছড়া পার হওয়ার সময় প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হন। পরদিন শনিবার বিকালে কাপ্তাই হ্রদ পরিবেষ্টিত চেঙ্গী নদীতে তার লাশ ভেসে উঠলে পুলিশ উদ্ধার করে।
নানিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুজন হালদার জানান, এক্কযেইয়া চাকমা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই এ ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়। শনিবার বিকালে নিখোঁজ ব্যক্তির লাশ চেঙ্গী নদীতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় রাঙামাটি শহরের রুপনগর এলাকায় পাহাড়ধসের শঙ্কায় পাশে বিএম ইনস্টিটিউট আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় আবদুল মতিন হাওলাদার (৬৫) নামে এক বয়স্ক ব্যক্তির হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান বলে স্থানীয়রা জানান। তবে তিনি আগেও অসুস্থ ছিলেন বলে জানান তারা।
রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুল আমিন বলেন, শহরের রুপনগর এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে একজন মারা গেছেন বলে শুনেছি।
এদিকে টানা বর্ষণে পাহাড়ধসের শঙ্কায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাঠে জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। রোববারও সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গিয়ে লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান ও পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। বিকালে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো পরিদর্মন করেন তারা।
প্রশাসন জানিয়েছে, টানা বর্ষণের ফলে শহরসহ জেলায় পাহাড়ধস ও বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা রয়েছে। বড় ধরনের যে কোনো ঝুঁকি এড়াতে শনিবার থেকে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের ৩টি টিমসহ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের সহযোগিতায় লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখনও ঝুঁকি নিয়ে অনেক লোকজন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। রাঙামাটি শহর ও উপজেলাগুলোতে মোট ১৮২ আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পাহাড়ধসের শঙ্কায় শহরের বেতার ভবন, বিএম ইনিষ্টিটিউট কলেজ ও লোকনাথ মন্দির আশ্রয় কেন্দ্রে এ পর্যন্ত ১৮১ জন আশ্রয় নিয়েছেন। কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া লোকজন সবার জন্য শুকনো খাবার ও ভাতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমা বিনতে আমিন।
রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. দিদারুল আলম বলেন, ২০১৭ সালের কথা চিন্তা করে রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিস সব প্রস্তুতি নিয়েছে। যে কোনো দুর্যোগ ঘটলেই তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা সম্ভভ হবে বলে তিনি জানান।
জেলা প্রশাসক মো. মোশাররফ হোসেন খান বলেন, একটি প্রাণও যাতে ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে তার জন্য বৃষ্টির মধ্যে সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসন মাঠে তৎপর রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব উপজেলায় ঝুঁকি মোকাবিলায় মাঠে কাজ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাঙামাটি শহরে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে থাকা লোকজনের জন্য ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ১৩ জুন ভয়াল পাহাড়ধসে রাঙামাটি জেলায় ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৮ সালের ১২ জুন জেলার নানিয়ারচরে পাহাড়ধসে ফের ১১ জনের প্রাণহানি হয়। এ ধরনের দুর্যোগে যাতে আর কোনো প্রাণহানির পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য সর্বাত্মক তৎপরতায় রয়েছে প্রশাসন। এদিকে শহরসহ জেলায় বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধসে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে। এতে বহু মানুষ বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাহাড়ধস ও বন্যাসহ সম্ভাব্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মাঠে তৎপর রয়েছে জেলার প্রত্যেক উপজেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বৃহস্পতিবার থেকে টানা বর্ষণের ফলে কাউখালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বড় ধরনের পাহাড়ধসের আশঙ্কা দিয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ধসের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠাতে মাইকিং করে সতর্কবার্তা প্রচার করা হচ্ছে। এলাকায় গিয়ে নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ২৬টি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে ৩৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে উপজেলা প্রশাসন। ২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড়ধসে কাউখালীতে ২১ জনের প্রাণহানি ঘটে।
কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা সাদিয়া নূরীয়া জানান, শনিবার সকাল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। বিশেষ করে ঘাগড়া ইউনিয়নের সব ওয়ার্ড, কলমপতি ইউনিয়নের সুগারমিল, মাঝেরপাড়া, বেতবুনিয়া ইউনিয়ন ও দুর্গম ফটিকছড়ি ইউনিয়নের সব এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা লোকজনদের নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। নিজেরা সরে না গেলে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হবে।
কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকাতেও পাহাড়ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে সতর্কবার্তা প্রচার করা হচ্ছে। উপজেলার মোট ৫টি ইউনিয়নেই আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কাপ্তাই উচ্চবিদ্যালয়ের আশ্রয় কেন্দ্রে এ পর্যন্ত ৫৫ জন অবস্থান নিয়েছেন বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।
কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন জানান, কাপ্তাইয়ের নতুনবাজার সংলগ্ন ঢাকাইয়া কলোনি এবং আফসার টিলা নামক এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের ঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা লোকজনদের আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে।