আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা আমাদেরকে নানা ভাবে বাঁধাগ্রস্ত করে। এবং এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে নানাভাবে নিরুৎসাহিত হতে বাধ্য হই। এখানকার মানুষ স্বাধীন ভাবে তাদের জীবনকে ধরে রাখতে পারতো। কিন্তু কালের চক্রে রাজনৈতিক ডামাঢোলে ও সারা বিশ্বে রাজনৈতিক কার্যক্রম শাসন ব্যবস্থার যে বিভিন্ন বাস্তবতা তার মধ্যে দিয়ে পার্বত্য এলাকার মানুষ ধীরে ধীরে স্বাধীনসত্তা হারাতে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে এসে আমরা কি দেখি কি অনুভব করি। পাহাড়ে একটা অনিশ্চিত জীবন, পাহাড়ের বুকে নিরাপত্তাহীনতা একটা বাস্তবতা। আজকে কেনো সেই বাস্তবতার মধ্যে আমরা বাঁচতে বাধ্য হচ্ছি বলে মন্তব্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা।
শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) মোনঘর এর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাঙামাটির রাঙ্গাপানি এলাকার মোনঘর ক্যাম্পাস মাঠে মোনঘর সুবর্ণজয়ন্তী কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্টানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।
এসময় তিনি আরও বলেন, আজকে যারা মনোঘরের শিক্ষাথী ছিলেন, মনোঘরীয়ান নামে তারা পরিচিত। তারা আমাদের পাহাড়ের সম্পদ। মনোঘর এই বিদ্যাপীঠ থেকে জন্মাবেন অনেক কবি সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ কবি সংগ্রামী মানুষ। মনোঘরে যারা জীবন অতিক্রম করে অবদান রেখেছেন তারা আগামীতে মনোঘরকে ধরে রাখবেন। আমি মনে করি পাহাড়ে যে বাস্তবতা ও নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চিত জীবন নিয়ে বসবাস করছেন। আমারা ফিরে যেতে চাই জীবন বৈচিত্র পাহাড় ঝর্ণা সে জীবনে । আমরা একটা বিশেষ শাসনে শোষিত হচ্ছি। সে বাস্তবতাকে ফিরে পেতে এখানকার মানুষ লড়াই সংগ্রাম করেছি। এই লড়াই সংগ্রামে মনোঘরের শিক্ষার্থীরাও অংশ নিয়েছে। আগামীতেও মনোঘরীয়ানরা পাহাড়ে প্রতিটি লড়াই সংগ্রামে এগিয়ে আসবে এই প্রত্যাশা করছি।
জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা ওরফে সন্তু লারমা বলেন, তারা শুধু তাদের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক পড়ে এগিয়ে যাবে সেটা না। আমাদের পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রী,শিক্ষার্থী যারা আছেন তারা তাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যে শিক্ষা জীবন সেটা যথেষ্ট নয়। মানুষ বেঁচে থাকে অনেক আশা আকংখা নিয়ে তার জীবনের অনেক কল্পনা থাকতে পারে বা থাকে।
সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে সাবেক শিক্ষক গরিকা চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে এসময় বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়, মং সার্কেলের প্রধান সাচিং প্রু চৌধুরী, মোনঘরের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সুভাষ চাকমার স্ত্রী রাখি দেওয়ান, মোনঘরের দাতা পিয়ার মার্চেল, মোনঘর পরিচালনা কমিটির সভাপতি শ্রদ্ধালংকার মহাথের এবং মোনঘরের প্রাক্তন ছাত্র ও ঘাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ শ্যামল মিত্র চাকমা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন মোনঘরের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক এবং স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা।
এর আগে সকালেই রাঙ্গাপানি পুলিশ লাইন মাঠ থেকে বর্ণাঢ্য র্যালির মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। র্যালি শেষে মোনঘর ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কেক কাটা এবং প্রতিষ্ঠানের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত একটি বিশেষ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সূচনা করা হয়। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল নবীণ ও প্রবীণদের মিলনমেলা। প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে বের হওয়া হাজারো প্রাক্তন শিক্ষার্থী একত্রিত হয়ে স্মৃতিচারণ করেন। স্মৃতিময় সেই মুহূর্তগুলোকে বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে পুরো আয়োজনটি পরিণত হয় এক আবেগঘন মিলনমেলায়।
এসময় চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবার্শীষ চাকমা বলেন, মনোঘরের জন্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের জন্য যারা যে অবদান রেখেছে তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। এই প্রতিষ্ঠানটি ৫০ বছর পেরিয়েছে সে জন্য আমি এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদকে ধন্যবাদ জানাই। পার্বত্য অঞ্চলের অনাথ, পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত প্রান্তিক এলাকা থেকে এসে মনোঘরে পড়াশুনা করছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনেক মেধাবি শিক্ষার্থী বের হবে ওই শিক্ষার্থী দেশ পরিচালনা করে। ১৯৭৪ সালে রাঙামাটির রাঙ্গাপানি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি পার্বত্য অঞ্চলের ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনাথ, ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আশ্রয়, শিক্ষা ও আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়তে নিরলস কাজ করে চলেছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানে যারা অর্থ দিয়ে শ্রম দিয়ে সময় দিয়েছেন সবার প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন।
উপস্থিত বক্তারা বলেন, পাহাড়ে শিক্ষা বিস্তারের আলোকবর্তিকা এই বিদ্যাপীঠ মোনঘর আগামী দিনগুলোতে আরো জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিবে এই প্রত্যাশা সবার। মনোঘর নামটি সকলের কাছে একটি পরিচিত নাম। পাহাড়ে শান্তি নিকেতন হিসেবে পরিচিত ও ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাবাদের শিক্ষা প্রসারে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান মোনঘর। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ শুক্রবার মোনঘর ৫০বছরে পা রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির এই সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে পাঁচ দশকের স্মৃতিতে নবীণ-প্রবীণদের যেনো মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে রাঙামাটি শহরের অদুরে রাঙ্গাপানি নামক এলাকায় চার একর জমিতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জ্ঞানশ্রী মহাস্থবিরের কয়েকজন শিয্য বিমল তিয্যে ভিক্ষু,প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু ও শ্রদ্ধালংকার ভিক্ষুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেন মোনঘর শিশু সদন। ‘মোনঘর’ শব্দের অর্থ পাহাড়ে জুম চাষের জন্য চাষীদের থাকার অস্থায়ী আশ্রয়স্থল। যতদিন পর্ষন্ত চাষীরা জুম ধানের বীজ থেকে অন্যান্য ফলন মোনঘরে তূলতে না পারে ততক্ষণ পর্ষন্ত এই আশ্রয়স্থলে থেকে কাজকর্ম চালিয়ে যায় জুমিয়ারা।
ঠিক তেমনি পাহাড়ের ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, বম, লুসাই, পাংখোয়াসহ অসহায় ছিন্নমূল অনাথ, গরীব ও মেধাবী ছেলে-মেয়েদের মোনঘরে আশ্রয় দিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয় । ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি পাহাড়ে অন্যতম শিক্ষার স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ দশকে কয়েক হাজার পাহাড়ি সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ-বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন । আজ পাহাড়ের এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান মোনঘরের সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসব। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে যাওয়া শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠী ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে স্মৃতি মন্থনে মেতেছেন। সেই সাথে নবীণরাও প্রবীণদের সাথে যোগ দেওয়ায় পরিণত হয়েছে মিলন একটি মেলা ।
মোনঘর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ অধ্যক্ষ ও নির্বাহী পরিচালক অসুক্ষ কুমার চাকমা বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠানে তিন হাজারের অধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে, এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫০ বছর উত্তীর্ণ করা নিঃসন্দেহে একটি গৌরবের বিষয়। আজ আমরা এই সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেই অর্জন উদযাপন করছি। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এই ৫০ বছরে আমরা কতটুকু অর্জন করেছি, তা আজ আমরা মূল্যায়ন করতে পারব। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে আরও সাফল্য বৃদ্ধির জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারব। যারা নিজেদের জীবন ও যৌবন বিলিয়ে দিয়ে মোনঘরকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন, আমি তাঁদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ মোনঘর পাহাড়ি অঞ্চলে শিক্ষার এক আলো ছড়ানোর প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। পার্বত্য অঞ্চলের অনেক স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষার পরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে মোনঘর সেই অনাথ, দরিদ্র ও দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছে। আমরা আবাসিক শিক্ষার মাধ্যমে পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলছি।মোনঘর থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এটি আমাদের জন্য গর্ব এবং ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আরও বড় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।