আবু আলী।
করোনা মহামারীসহ নানা কারণে সাধারণ মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠছে। লাগামহীন বাজারে নেই কোনো নজরদারিও। ব্যয় সংকোচন করে কোনোমতে টিকে আছে বহু পরিবার। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে মানুষ চরমভাবে আর্থিক চাপে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় সরকার কিছুটা উদ্বিগ্ন। অপরদিকে ‘চাপ এসেছে’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও।
জানা গেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ওপেন মার্কেট সেলসের (ওএমএস) আওতা বাড়িয়েছে। ফলে এ খাতে ভর্তুকিও বাড়ানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার তার ওএমএস ভর্তুকি ৮০০ কোটি টাকা বা ১৯ শতাংশ বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে রমজান মাস সামনে রেখে ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডালের মতো ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়াতে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ জন্য দ্রুত এলসি খোলার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পেঁয়াজ, ছোলা এবং খেজুরের আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় রয়েছে। ওমিক্রন মোকাবিলায় বিধিনিষেধের মধ্যেও বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ জন্য সব ধরনের পণ্যবাহী যান চলাচল অবাধ রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিধিনিষেধের মধ্যেও ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে।
জানা গেছে, পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (টিসিবি) এবারও দ্বিগুণ পরিমাণ নিত্যপণ্য বিক্রি করবে সারাদেশে। সংস্থাটির মূল লক্ষ্য, রোজায় স্বল্পআয়ের মানুষের কাছে সস্তায় ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ এবং খেজুরের মতো ভোগ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়া।
পণ্য নিয়ে কারসাজি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে রমজানে মাসব্যাপী বাজার তদারকি করা হবে। এ ছাড়া খাদ্যে ভেজালরোধে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের বিশেষ টিম বাজার তদারকি করবে। ন্যায্যমূল্য ও সঠিক পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা, তা দেখভালে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাজার তদারকি করবে র্যাব ও পুলিশের বিশেষ টিম। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘বাজার মূল্য পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ’বিষয়ক স্থায়ী কমিটি কাজ করবে।
ভোজ্যতেলের দাম কমাতে এনবিআরও নানা উদ্যোগ নেবে। সেক্ষেত্রে রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনশীল রাখার জন্য আমদানি করা অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের ওপর ৪ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হতে পারে। চিনির দাম কমাতে অগ্রিম কর এরই মধ্যে কমানো হয়েছে।
এদিকে আসন্ন রমজান উপলক্ষে সাশ্রয়ীমূল্যে টিসিবির পণ্য নিম্নআয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে গতকাল মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর সিনিয়র সচিব এবং সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের ওপরে উঠেছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভোক্তা মূল্যসূচক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে ওঠে, আগের মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সংস্থাটি বলছে, গত কয়েক মাস থেকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতে। ফলে খাদ্যবহিভর্‚ত পণ্যের দাম আরও বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ জরুরি নিত্যপণ্যের বাজার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, এক বছরে যে হারে দাম বেড়েছে, গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম এতটা বাড়েনি। পণ্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে, যা চরম ভোগান্তিতে ফেলবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের।
এ জন্য দেশের পণ্যমূল্যের লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সম্প্রতি সংস্থাটির এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রধানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে। সে সময় তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করে। আলোচনায় সরকারের আয়-ব্যয়, বাজেট বাস্তবায়ন ও আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের রাজস্ব আয় নিয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সেখানে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও কড়া পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে উৎপাদন, বণ্টন, পরিবহন ও সরবরাহ পর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে আইএমএফ। অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মোটা চালের দামও ৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। ভোজ্যতেলের কেজি প্রায় ১৬০ টাকা। চিনির কেজিও ১০০ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। শুধু তাই নয়, ভরা মৌসুমেও বাজারে সবজির দাম চড়া। মাছ, মাংসের দাম তো সারাবছরই ঊর্র্ধ্বমুখী। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে পরিবহন খরচও। যার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
আইএমএফ তাদের পর্যবেক্ষণে বলছে, করোনাপরবর্তী এক নতুন অর্থনীতির মুখ দেখবে বিশ্ববাসী। এতে অর্থনীতিতে নতুন চাহিদা সৃষ্টি হবে। এ জন্য নতুন নতুন বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, যা কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়ক ভ‚মিকা রাখবে। এসব বিষয় সামনে রেখে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এক ধরনের কঠিন চ্যালেঞ্জ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চাহিদার সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলোও বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলেছে সংস্থাটি।-দৈনিক আমাদের সময়