রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর ও পুণ্যময় পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ৪৪তম মহান দানোত্তম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান।
শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) সকালে রাজস্থলী কেন্দ্রীয় মৈত্রী বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই মহতী ধর্মীয় আয়োজনে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো বৌদ্ধ ভিক্ষু, দায়ক-দায়িকা ও পূণ্যার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। সকাল থেকেই ভক্তবৃন্দের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বিহার এলাকা। পিন্ডদান, সংঘদান, চীবর দানসহ বিভিন্ন দান কর্মসূচির মাধ্যমে দিনব্যাপী চলে উৎসবের নানা আনুষ্ঠানিকতা।
প্রথম পর্বে প্রাতঃকালীন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় পিন্ডদান ও সংঘভোজন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পর্বে বিকেলে পূণ্যার্থীরা পঞ্চশীল গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। জগতের সকল জীবের সুখ, শান্তি ও মঙ্গল কামনায় পাঠ করা হয় মঙ্গলাচরণ ও বিশেষ প্রার্থনা। এছাড়াও অনুষ্ঠিত হয় অষ্টপরিষ্কার দান, পানীয় দান, বুদ্ধমূর্তি দান, চীবর দান, কল্পতরু দানসহ নানাবিধ দান কার্যক্রম।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উঃ কিত্তিমা মহাথের, অধ্যক্ষ, চুশাক পাড়া বৌদ্ধ বিহার। প্রধান আশীর্বাদক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভদন্ত ধর্মানন্দ মহাথেরো, অধ্যক্ষ, রাজস্থলী কেন্দ্রীয় মৈত্রী বৌদ্ধ বিহার। ধর্মদেশক হিসেবে দেশনা প্রদান করেন ভদন্ত উত্তমা নন্দ থেরো, অধ্যক্ষ, সোনাইছড়ি বৌদ্ধ বিহার।
এছাড়াও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উঃ ইন্দোবাসা মহাথেরো, অধ্যক্ষ, হ্নারামুখ পাড়া বৌদ্ধ বিহার, অনুষ্ঠানের স্বাগতম বক্তব্য রাখেন, রাজস্থলী মৈত্রী বিহারের, কেন্দ্রীয় কমিটি , সাধারণ সম্পাদক, উজ্জ্বল কান্তি তচংগ্যা।।
বক্তারা তাদের ধর্মদেশনায় বলেন — “চীবর দান শুধুমাত্র একটি দান নয়, এটি হলো আত্মশুদ্ধি, সহমর্মিতা ও পরম দয়ার প্রতীক। এই দানের মাধ্যমে মানুষ পরার্থে নিজের সামান্য শ্রম ও ভালোবাসা উৎসর্গ করে সত্যিকারের পুণ্যের স্বাদ অনুভব করে।”
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ভিক্ষু ও ভক্তবৃন্দ দেশ ও জাতির মঙ্গল, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবতার বিকাশ কামনায় বিশেষ প্রার্থনা করেন।
আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় তাঁর প্রধান নারী উপাসিকা বিশাখা মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা তৈরি, রং করা, বয়ন ও সেলাই করে একটি চীবর (বিশেষ পরিধেয় বস্ত্র) তৈরি করে দান করেছিলেন। সেই দানের ঐতিহ্যই আজও ‘কঠিন চীবর দান’ হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছেন।
দিনব্যাপী এই ধর্মীয় দেশনা, সংঘদান, দান কর্ম ও প্রার্থনায় পূণ্যার্থীরা অংশ নিয়ে শান্তি, সহমর্মিতা ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দেন। বিকেলের দিকে পুরো বিহার প্রাঙ্গণ যেন রূপ নেয় এক অনন্য ধর্মীয় মিলনমেলায়।
উৎসব শেষে পূণ্যার্থীদের উদ্দেশ্যে আশীর্বাদ প্রদান করেন ভদন্ত ধর্মানন্দ মহাথেরো, বলেন “মানব জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হলো মনকে পরিশুদ্ধ করা। চীবর দানের মাধ্যমে আমরা পরার্থে দানের মহিমা উপলব্ধি করতে পারি, যা সকল জীবের মঙ্গল ও শান্তি বয়ে আনে।”
পাহাড়ি জনপদের রাজস্থলীর শান্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত এবারের ৪৪তম দানোত্তম কঠিন চীবর দান উৎসব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য হয়ে উঠেছে এক অনন্য ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধনের প্রতীক, যেখানে ধর্মীয় ভক্তি, দানশীলতা ও মানবতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে রাজস্থলীর কেন্দ্রীয় মৈত্রী বৌদ্ধ বিহার।

 
         
                     
  







 
                                     
                                    








