৭০-এর নির্বাচনের পর সারাদেশের মত আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে কাপ্তাই। তখন কাপ্তাই শহর ছিল মহাকুমা। ১৯৬৫ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে কাপ্তাই লেকের সৃষ্টি হয়। বাঁধ দেওয়ার পর কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এই জল বিদ্যুৎ সৃষ্টি হবার পর এখানে বাঙালী – অবাঙালি অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শ্রমিক যোগদান করে। যার ফলে এই শহরে প্রচুর লোকের আনাগোনা ঘটে।
এছাড়া চন্দ্রঘোনা কর্ণফুুলী পেপার মিলেও (কেপিএম) স্বাধীনতার আগে প্রচুর পাকিস্তানি সহ বাঙালিরা কাজ করতেন। এক অর্থেই সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি ব্যস্ততম শহর ছিল কাপ্তাই।
যুদ্ধের দামামা যখন সারা বাংলাদেশে লেগে গেছে সেই ৭০ সাল হতে কাপ্তাইয়ে সংগঠিত হতে থাকে মুক্তিকামী ছাত্র, শ্রমিক জনতা শত শত আন্দোলনকারী।
সাথে যোগ দেন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৎকালীন ম্যানেজার এ কে এম শামসুদ্দিন সহ কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সিনিয়র বাঙালী কর্মকর্তাগণ। গঠন করা হয় সংগ্রাম কমিটি।
বাঙালী ইপিআরদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় শক্ত প্রতিরোধ।
১৯৭১-সালের ১৪এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার শেলিং করতে করতে কাপ্তাই দখলে নেয়। এরপর তারা শুরু করে নির্যাতন ও নারকীয় হত্যাকান্ড। ১৫ এপ্রিল বাসা থেকে ডেকে নিয়ে কাপ্তাই বাঁধের উপরে গুলি করে প্রকৌশলী এ কে এম শামসুদ্দিনকে হত্যা করে পাক বাহিনী। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় কাপ্তাই প্রজেক্টের অনেক কর্মকর্তাসহ আন্দোলনকারীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অনেক নারীকে ক্যাম্পে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালায় হানাদার বাহিনী। আগুনে জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক নারী পুরুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ৩২জন শহীদের নাম পাওয়া গেলেও হত্যা করা হয় অনেককে। কিন্তু বাকীদের নাম পরিচয় এমনকি তাদের লাশও পাওয়া যায়নি। সেই সময়ের কাপ্তাইয়ের সেই গণহত্যা নিয়ে সাংবাদিক ইয়াছিন রানা সোহেল এর তথ্য ও গবেষণায় তরুণ নাট্যকর্মী সোহেল রানার রচনা ও নির্দেশনায় নাটক ” ৭১ এর রক্তাঞ্জলী ” গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টায় রাঙামাটির শহীদ আব্দুর শুক্কুর স্টেডিয়ামে মঞ্চস্থ হয়। স্টেডিয়ামে উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক কর্মী সহ শত শত দর্শকের তুমুল করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে অনুষ্ঠানস্থল।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দেশের ৬৪ জেলায় গণহত্যা নাটক মঞ্চায়নের অংশ হিসেবে রাঙামাটিতেও জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্য দলের পরিবেশনায় এক শত শিল্পীর প্রানবন্ত অভিনয়ে “৭১-এর রক্তাঞ্জলি” নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়েছে বলে জানান রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার অনুসিনথিয়া চাকমা ।
নাটকটির মূল ভাবনা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক দেশবরেণ্য নাট্য পরিচালক লিয়াকত আলী লাকি। গবেষণা নির্বাহী আবু ছালেহ মোঃ আব্দুল্লাহ, প্রযোজনা ও মঞ্চায়ন নির্বাহী আলি আহমেদ মুকুল, আলোক, মঞ্চ ও মিউজিক পরিকল্পনা ঃ আশিক সুমন, মঞ্চায়ন ও সার্বিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার মোসলেম উদ্দিন সিকদার লিটন, সমন্বয়কারী রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার অনুসিনথিয়া চাকমা এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক বুলবুল।
নাটক দেখতে আসা কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্য বিভাগের প্রধান আনিছুর রহমান এবং বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটি কেন্দ্রের সংগীত প্রযোজক রনেশ্বর বড়ুয়া জানান, নাটকটির মাধ্যমে সেই সময়ের কাপ্তাইয়ের নারকীয় গণহত্যার ইতিহাস আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে।
কাপ্তাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী জানান, দর্শক গ্যালারিতে বসে যখন আমি নাটকটি উপভোগ করছি, তখন আমার সামনে সেই ৭১ এর দিনগুলো ভেসে আসছে।
নাটক শেষে বাচিক শিল্পী মুজিবুল হক বুলবুল ও শিখা ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা। ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন শিল্পকলার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরীর সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক মোঃ মামুন, পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদা আকতার, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী কামাল ও শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা শিল্পকলার সাধারন সম্পাদক মুজিবুল হক বুলবুল।
শুরুতেই প্রদীপ প্রজ্জলন করা হয়। এরপর নাটক মঞ্চায়ন। পরে আলোচনা সভা শেষে অতিথিবৃন্দ, তথ্য সরবরাহ ও গবেষণায় ইয়াছিন রানা সোহেল, নাটক রচনায় মোঃ সোহেল রানা ও মঞ্চ পরিকল্পনায় সৈয়দ আশিক সুমনকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়।