বৃহস্পতিবার দুপুর আনুমানিক সাড়ে ১২টা/ ১টা। খাগড়াছড়ি শহরের সাপ্তাহিক বাজারবার হিশেবে সরগরম মাছের বাজার। বাজারভর্তি ক্রেতা- বিক্রেতারা লক্ষ্য করেন, মাঝ বয়সী এক পাহাড়ি ( সোনালি চাকমা) নারী ৬/৭ বছর বয়সী এক শিশুকে নিয়ে অহেতুক ঘোরাঘুরি করছেন। খাগড়াছড়ি সদরের জংলী টিলা এলাকার কয়েকজন পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে জানতে পারেন, সোনালি চাকমা অভাবের তাড়নায় শিশু সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমাকে টাকার বিণিময়ে পালক (দত্তক) দিতে চান। আগ্রহী এক বাঙালি শোনামাত্রই নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। জংলী টিলার লোকজন তাতে বাধ সাধেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুনীল জীবন চাকমা’র স্ত্রী রোজিনা চাকমা দীর্ঘদিন ধরে একটি ছেলে সন্তান পালক নেয়ার জন্য খুঁজছিলেন। জমে যাওয়া লোকজনের মধ্যে সোনালিকে ছেলেধরা কীনা এমন শোরগোল উঠতেই কয়েকজন আবার সোনালির দিকে তেড়েও উঠেন। এসময় সোনালিকে বেশ অস্বাভাবিক এবং অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে সন্দেহ হচ্ছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জংলী টিলার লোকজন রোজিনা চাকমাকে টেলিফোনে বিষয়টি জানান। নিজের আগ্রহের কারণে তিনি দ্রুত ইউনিয়ন পরিষদ সচিব আর্জেন্ট চাকমাকে সাথে নিয়ে মাছ বাজারে আসেন। ফাঁকে মাসিক আইন-শৃঙ্খলা সভা শেষ করে রোজিনা চাকমা’র স্বামী চেয়ারম্যান সুনীল জীবন চাকমাও উপস্থিত হন। তাঁরা শিশু রামকৃষ্ণ এবং মা সোনালিকে নিয়ে শহরের মধুপুর বাজার এলাকায় চলে আসেন। পথিমধ্যে সোনালি’র জন্মগত রোগ ‘মৃগী’র প্রভাবে একবার মুর্চ্ছাও যান। পরে জ্ঞান ফিরলে ক্ষুধার্ত বিধায় একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে মা- ছেলেসহ সবাই মিলে দুপুরের খাবার সারেন। এসময় অন্যান্যদের মধ্যে জেলা বিএনপি’র যুগ্ম-সা: সম্পাদক ও পানছড়ি থেকে মনোনীত সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য অনিমেষ চাকমা রিংকুও উপস্থিত ছিলেন।
এভাবেই ঘটনার সূত্রপাতের বর্ণনা দেন বৃহস্পতিবার রটে যাওয়া শিশু বিক্রির আলোচিত খবরের শুরু’র দিকের প্রত্যক্ষদর্শী কমলছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান সুনীল জীবন চাকমা, তাঁর স্ত্রী রোজিনা চাকমা, বিএনপি নেতা অনিমেষ চাকমা এবং কমলছড়ি ইউপি সচিব আর্জেন্ট চাকমা।
তিনি আরো জানান, বিষয়টি ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমাকে টেলিফোনে জানানোর পর তিনি সোনালির অভিভাবকদের পাঠালে আমরা তাঁদের মাধ্যমে পাকুজ্যাছড়িস্থ বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। এসময় সবাই মিলে বেশকিছু টাকাও দেয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে বিষয়টিকে শিশু বিক্রির বর্ণনাকে তাঁরা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, চাকমা সমাজে শিশু বিক্রির মতো জঘন্য ঘটনার কোন নজির নেই। চাকমা জনগোষ্ঠি এ ধরনের অপ-সংস্কৃতির সাথে পরিচিত নন। এটা বিভ্রান্তি এবং অপ-প্রচারের শামিল।
না, এতেই থেমে থাকলে পাঠকের মনে নানা খটকা লাগতে পারে। তাই দুপুর ১২টা নাগাদ সরেজমিনে ছুটে যাই খাগড়াছড়ি জেলাসদর থেকে সড়ক পথে ১৭ কিলোমিটার দূরের পানছড়ি উপজেলার ভাইবোন ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম ‘পাকুজ্যাছড়ি’।
গ্রামে ঢোকার মুখেই গ্রামীণ নারী বনলতা ত্রিপুরা’র চায়ের দোকান। নানা বয়সী ১০/১২ জন নারী পুরুষ কেউ লুডু খেলছেন, কেউ তামাক বা বিড়ি ফুঁকছেন অথবা কেউ সোনালি আর শিশু রামকৃষ্ণ’র ঘটনাই আলোচনা করছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ অনিল বিকাশ চাকমা। পেশায় কৃষক এই প্রবীন জানালেন, ঘটনাটি তিলকে তাল করার মতো হয়েছে। স্বামী পরিত্যাক্তা সোনালি অভাবগ্রস্ত। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে সে অনেকের কাছেই শিশু সনতানকে পালক (দত্তক) দিতে চেয়েছিল। গ্রামে আগ্রহী কাউকে না পেয়ে হয়তো বাজারে নিয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা যে এতো বড়ো হয়ে পুরো গ্রামের মানুষের মুখ ছোট করে দেবে তা আমরা ভাবতেও পারিনি।
উপস্থিত খোদ সোনালি’র আপন ছোট ভাই ভরত চাকমাও বললেন, তাঁর বড়বোন ‘আসলে পাগল’। শুধু তিনি বা তাঁরা নন, ওই দোকানে উপস্থিত রিপনা চাকমা, অনাদি রঞ্জন চাকমা, ভানুমতি চাকমা, কালাবাতি চাকমা, আলোড়ন চাকমা কেউই শিশু বিক্রির ঘটনায় সায় দিতে পারেননি। তাঁদের সবার এক কথা সোনালি অসহায় হয়ে শিশুটির ভালো ভরণ-পোষনের জন্য নির্ভরযোগ্য মানুষই খুঁজছিলেন।
এবার যাওয়া যাক সোনালি চাকমা’র বাপের বাড়ি বাড়ি। যেখানে বছর দেড়েক থেকে সোনালি আশ্রিত জীবন-যাপন করছিলেন শিশু সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমাকে সাথে নিয়ে।
কথা হয় সেনালি চাকমা, তাঁর বয়োবৃদ্ধ বাবা কালাবো চাকমা (৮০), মা কালাবি চাকমা (৬৫), ভাইয়ের স্ত্রী তুংকী চাকমা ও মমতা ত্রিপুরা, মামী বীর রানী চাকমা এবং প্রতিবেশী রিনু চাকমা’র সাথেও।
তাঁরা জানান, বছর আটেক আগে চতুর্থ বারের মতো পানছড়ির দুর্গম শনখোলা আদামের (গ্রাম) নব্বই উর্ধ্ব ওজা বুজ্যা নামের এক বৈদ্যকে বিয়ে করেন সোনালি চাকমা। মূলত: তাঁর রোগমুক্ত করে দেবে এই ফাঁদে ফেলেই ওই বৃদ্ধ সোনালিকে বিয়ে করেন। সেই ঘরের একমাত্র সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমা। প্রথম যৌবনে সোনালি প্রথম বিয়েতে একক সংসার করতে পারলেও পরের তিনটি সংসারই দ্বৈত অথবা বিপতœীক স্বামীই তাঁর ভাগ্যে জুটেছে। প্রথম ঘরের সন্তানরা স্বচ্ছল জীবন যাপন করলেও কেইউ তাঁর দেখভাল করেন না। এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় সংসারের এক সন্তানকে সোনালি দত্তক দিয়েছিল। তখন সে সন্তানকে ¯েœহের বশে ফিরিয়ে এনেছিলেন, সোনালি;র বাবা কালাবো চাকমা।
রোগগ্রস্ত দরিদ্র এবং কর্মহীন অথবা শারীরিক দুর্বলতা বশত: অলস সোনালি আশেপাশের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনাহুতভাবে যাতায়াত করেন। ওখান থেকে নিয়ে খাবার-চাল-ডাল দিয়ে চলতেন। কখনো কখনো ভিক্ষাও করতেন। তবে কখনো তাঁর ভাই এবং ভাইয়ের স্ত্রীরা তাঁকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতেন না।
দিনমজুর ভাইয়ের স্ত্রী তুংকী বলেন, আমরা নিজেরাও ঠিকমতো চলতে পারি না। তাই তাঁর এবং শিশুপুত্র রামকৃষ্ণকে পালনে কষ্টকর।
কথ বলতে বলতে দেখি, সোনালি’র জড়াজীর্ণ সেই কুঁড়েঘরটি। একপাশে গরুর গোয়াল আর একপাশে সোনালির রান্নার চুলা, শোয়ার খাট, লাকড়ি আর স্তুপাকার সংসারের অন্য সব সামগ্রী।
কেন এমন ঘরে তাঁর ঠাঁয় সেই প্রশ্নের জবাবে পরিবারের সব সদস্যের উত্তর, সোনালি মৃগী রোগী। মানসিকভাবে ভালো না। রোগের প্রকোপ বেড়ে গেলে অস্বাভাবিক আচরণ করে। তাই মাস দেড়েক আগে আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সোনালি নিজেই স্বীকার করেছেন, মাস দেড়েক থেকে ভাই এবং মা-বাবা থেকে আলাদা ঘরে থাকছেন। সোনালির ঘরে তিনদিকে দুটি করে ছয়টি ইট দিয়ে বানানো চুলোয় জ¦ালানো আগুনে পোড়া ইটে এখনো খুব বেশি কালি লাগেনি। তাতে সহজেই বোঝা যায়, সপ্তাহ দুয়েক থেকে ওই চুলায় রান্না সারছেন সোনালি।
নিজের শিশু সন্তানের প্রতি কেন এমন আচরণের আশ্রয় নিলেন সোনালি চাকমা? তার জবাবে অসংলগ্নভাবে তিনি জানান, জীবনের একটি সংসারেও শান্তি পাননি। নিজের পেটে ধরা আগের ঘরের সন্তানরাও দেখভাল করেন না। কোথাও একটু থাকার জায়গা পাচ্ছেন না। কাজকর্মও করতে পারেন না। তাই সন্তানের ভবিষ্যত যাতে কোনভাবে বেঁচে থাকার মতো হয়, সেজন্য মানুষ খুঁজছিলেন। এবং সাথে নিজের জন্য যদি কিছু টাকা পাওয়া যেতো তাহলে নিজেও খেয়েপরে বেঁচে থাকতেন; এমন আশা থেকেই ছেলেকে নিয়ে বাজারে গিয়েছিলেন। তবে তিনি পালক (দত্তক)-এর বিষয়টি বুঝতে পারলেও বিক্রির বিষয়টি পরিস্কার করতে পারেননি।
তবে এখনও দৃঢ়তার সাথে দাবী করেন, তাঁর ছেলে রামকৃষ্ণকে অনেক ভালোবাসেন। ছেলেটি যাতে লেখাপড়া করে বড়ো হয়ে তাঁকেও (সোনালি) দেখাশোনা করতে পারে, সেজন্য সকলের সাহায্যপ্রার্থী।
পাড়া প্রধান সানাঅং মারমা মাধুরী জানান, তিনি খবর পেয়ে পরিস্থিতি দেখতে এসেছেন। তিনি জানান, শারীরিক-মানসিক এবং আর্থিকভাবে বিপন্ন এই নারীর দুরাবস্থা দেখে খুবই খারাপ লাগছে। তাঁর পাশে দাঁড়ানো সকলের দায়িত্ব। পরিবারের লোকজন আরো একটু সহানুভুতিশীল হলে হয়তো তার জীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসতো।
স্থানীয় ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমা জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে কমলছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান সুনীল জীবন চাকমা’র মাধ্যমে জানার পর ওইদিনই আমি সোনালিদের বাড়িতে সরেজমিনে ঘুরে আসি। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন এবং উর্ধ্বতন জনপ্রতিনিধিদেরও জানাই। খবর পেয়ে শুক্রবার দুপুরে নারী সংসদ সদস্য বাসন্তি চাকমা কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে সোনালি’র পিতৃভূমিতে হাজির হন। এসময় তিনি তাৎক্ষনিক ৬০ কেজি চাল-দুই লিটার তেল, দুই লিটার ডাল, তিনপদের মসলাসহ কিছু নগদ টাকা প্রদান করেন।
তিনি আন্তরিকভাবে সোনালি চাকমা এবং তাঁর স্বজনদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে সোনালি এবং তাঁর শিশু পুত্রের জন্য ভালো কিছু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তবে সুজন চাকমা কোনভাবে ঘটনাটিকে সন্তান বিক্রি মানতে নারাজ। তিনি এই ধরনের প্রচারণায় দু:খ প্রকাশ করে বলেন, সমাজে এ ধরনের অনেক অভাবী মানুষ আছেন। যাঁরা মাসিক বা বাৎসরিক টাকা বা বেতন বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ছেলে মেয়েদের অন্যের বাড়িতে রাখেন। হয়তো শিশু বলে বিষয়টিকে সবাই অন্যভাবে নিয়েছেন। তিনি এই অপ্রত্যাশিত অপ-প্রচারের ঘটনায় নিজেকে মর্মাহত এবং অসম্মানবোধের শিকার বলেও মন্তব্য করেন।
এদিকে নারী সংসদ সদস্য বাসন্তি চাকমা সোনালি চাকমা’র পাকুজ্যাছড়িস্থ ঘরবাড়ি দেখে আসার খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বেশ কয়েকটি নিউজ পোর্টালে প্রচারের পর বিষয়টি সারাদেশেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সরকারের উদ্যোগে যেখানে লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষ ঘর এবং ভূমি পাচ্ছে সেখানে সোনালি’র মতো অসহায় নারী এমন অসহায় বসতি সত্যিই বিবেককে নাড়া দেয়।
আর সেই তাগাদা থেকেই খবরটি শোনার পর পরই পাকুজ্যাছড়ি ছুটে যান সংসদ সদস্য বাসন্তি চাকমা।
তিনি জানান, অভাবের কারণে হাট বাজারে নিজের সন্তান বিক্রির একটি খবর পেয়ে অবাক হলাম। এটা কি করে হয়। বৃহস্পতিবার নিজে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিলাম। সোনালী চাকমা মানসিকভাবে একটু অসুস্থ বটে। বৃদ্ধ স্বামীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পর ভাইবোনছড়ার পাকোজ্জাছড়িতে বাবার দেয়া জায়গায় ছোট্ট একটি ঘর তুলে থাকছেন। গোয়ালঘরের সাথে লাগায়ো ছোট্ট রুমটি দেখে খুব খারাপ লেগেছে। অসুস্থতা, আয় রোজগার না থাকার কারণে মানসিকভাবে সে ভেঙ্গে যায়। তাই
চঞ্চল ছয় বছর বয়সী শিশুটি রামকৃষ্ণ চাকমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাউকে দত্তক দিতে চেয়েছিল। বিষয়টি জানার পর তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ায় সংশ্লিষ্ট জনপপ্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আপাতত তাদের চাল, ডাল, তেল, মরিচসহ
৬মাসের খাবার সামগ্রী, কাপড় দিয়েছি। সাথে কিছু নগদ অর্থ প্রদান করেছি। শিশু রামকৃষ্ণকে সরকারি শিশু সদনে দেয়া যায় কিনা সেটি আমরা দেখব। একই সাথে একটি সরকারি ঘর দেয়ার বিষয়টিও দেখব।
এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন আর হতে না হয় সেই প্রার্থনা করি।