ব্যক্তি মানুষটির জীবিতাবস্থায় আমরা তাঁর মন্দ নিয়ে খুব আলোচনা করতে পছন্দ করি। মানুষটির আড়ালে এগুলো করে থাকি। আর মানুষটি যখন মারা যান, আমরা তাকে নানা বিশেষ্য বিশেষণ দিয়ে প্রশংসা করতে থাকি। তাঁর ভাল কাজগুলোকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি। তাঁকে নিয়ে প্রকাশ্যে একটি খারাপ মন্তব্যও করি না। কেউ কিছু বলার চেষ্টা করলে বলি, ‘মানুষটা মারা গেছে, তাকে আর বলে লাভ কি? বরং পাপ হবে, লোকে খারাপ বলবে’ ইত্যাদি। তাই মানুষটি মারা গেলে সব ভাল দিয়ে, তাকে স্বর্গে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি।
পাড়ার ভবঘুরে, চোর, বশংবদ, মদখোর মানুষটি হঠাৎ রং কাপড় নিলে তাকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি। সাতদিন পরে রং কাপড় ফেলে আবার আগের চরিত্রে ফিরবে জানি, তারপরও তাকে বিহারে গিয়ে প্রার্থনা করি। কিছু বললে সবাই বলবে, ‘রং কাপড় নিয়েছে, পাপ হবে’। পাহাড়ে কিছু কিছু বিহারে ভিক্ষুদের দ্বারা অনৈতিক কর্ম শুনা যাবে। কাউকে তু’ শব্দটি করতে দেখা যায় না। পাপের ভয়ে বিহারে গেলে তাকেও প্রার্থনা, দান করতে দেখা যায়।
ভাল-মন্দ, পাপ-পূণ্যকে মিলে একত্রে রেখে শান্তি, সুন্দর থাকার বৃথা চেষ্টা করি। বৃথা বলছি এই জন্য যে, কেউ বলতে চাইলে বলতে দিচ্ছি না ঠিকই, কিন্তু ঐ একই মানুষটি আড়ালে অন্য কোথাও ঠিকই বদনাম, সমালোচনা করছি বিষয়টি নিয়ে। অন্যের সামনে পাপ-পূণ্য বলে ঢেকে রাখলেও আড়ালে সমালোচনা করতে পছন্দ করি। পরিচিত এক মৌজা প্রধান, হেডম্যান, তার জীবদ্দশায় এমন কোন কাজ রাখেননি, তিনি করেননি। নিজ গ্রামের মানুষগুলোকে নিজেদের জায়গা জমিতে দিনমজুরি বানিয়ে তবেই মারা যান। অবাক করে হলো তার মৃত্যুতে মানুষের ঢল আর শবদেহের সাজ-সজ্জা হতে দেখে। আমরা তাকে এমনভাবে বিদায় দিয়েছি যেন তিনি সমাজের জন্য বিশেষ কিছু একটা করেছেন। বাস্তবে হয়তো আমরা মন থেকে তাকে ভালোবেসে জড়ো হয়নি। হয়েছি পূণ্যলাভের/লোভের আশায়।
একজন হেডম্যানের মৃত্যুতে সামিল হতে পারলে অনেক পূণ্য পাওয়া যাবে ইত্যাদি ভেবে। ফলে ফলাফল অনেকটা শূণ্য। আমরা তার ছেলেকে শেখাতে পারিনি। ছেলেটি বাপের চেয়ে শিক্ষিত বলে, সচেতন হওয়ার কথা কিন্তু কিছুই হয়নি। কিছুই শেখাতে পারিনি। এখন ছেলেটি বাপের চেয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে শুনা যায়। খুঁজতে গেলে ‘ব্রীজের নিচে’ পাওয়া যায়। ব্রীজের নিচে কি হয় আমরা জানি। কোথায় কি ফাঁক ফুকুর আছে, তথাকথিত ‘খাস জমি’ খুঁজে বের করে বিক্রি করবে, গ্রামে গ্রামে পরিবারে পরিবারে ঝগড়া লাগাবে। হচ্ছেও তাই। আমরা যদি তার বাবার মৃত্যুতে কম আগ্রহ, কম গুরুত্ব দেখাতে পারতাম, ছেলেটি কিছুটা হলেও সচেতন হতো।
গ্রামে থাকতে গেলে গ্রামীন মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতো। একইভাবে আপনার আমার কত কত পরিচিত মুখ, পদ-পদবি ব্যবহার করে সমাজের জন্য ‘কচু’ করেছেন, করছেন জানার পরও তাদের প্রশংসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করে ফেলি। আমরা কেউ প্রকাশ্যে সমালোচনা করি না। টিকে থাকার প্রশ্নে গঠনমূলক সমালোচনার সংস্কৃতি গড়ে উঠা আবশ্যক বলে মনে করি। সমালোচনা না থাকলে ব্যক্তি মানুষটি কোনদিন সংশোধন, সংযম হওয়ার চেষ্টা করবেন না। হবেন না। মরা মৃত্যুতে ভাল কাজের পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষটি কর্তৃক গৃহিত কর্মকান্ডের মাঝে নৈতিবাচক দিকগুলোকে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা দরকার।
আমরা কথায় কথায় বলি, কেউ দোষ গুণের উর্ধ্বে নই, কিন্তু একজন মানুষকে আমরা প্রকাশ্যে শুধু প্রশংসা করতে আর গুণের গান গাইতে, শুনাতে ও শুনতে পছন্দ করি। বেশ কয়েক বছর আগে প্রফেসর ড. এ. কে. নাজমুল করিমকে নিয়ে লেখা একটি কলাম পড়ার সুযোগ হয়েছিল। যে কলামটিতে ড. নাজমুল করিমকে বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান পঠন-পাঠনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখের পাশাপাশি, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ, ৭১ সালে তাঁর নিবর ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করা হয় (দেখুন: ড. জিয়া রহমান ও মো. নাজমুল আরেফিন, ‘সমাজচিন্তার বাতিঘর’, সমকাল, ১ আগষ্ট, ১৭)। এর মাধ্যমে তাকে ছোট করা হয়নি। একজন ব্যক্তি মানুষকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করি। আমরা পাঠকও বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের জনককে বুঝতে পারি।
পাহাড় সমাজে কোন মানুষ মারা গেলে পুষ্পমাল্য দেয়া, পুষ্পমাল্যের নামে প্লাস্টিক ফুল দেয়া একটি নতুন ধারা চালু হয়েছে (দেখুন: ঞ্যোহ্লা মং, ‘প্লাস্টিক ভালোবাসা’, সমকাল অনলাইন পোর্টাল, ১২ আগস্ট ২২)। পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষটির নামে শোক বার্তা লিখে টাঙানোর চেষ্টা চলছে। প্রভাবশালী ব্যক্তির অনেক দূরের আত্মীয় স্বজনের মরামৃত্যুতেও শোকে এলাকায় পোষ্টার ছেয়ে যাচ্ছে। একদল পূণ্য লাভের আশায় মরা-মৃত্যুতে ভিড় করে।
আরেকদল সুবিধা লাভের আশায় সমাজজীবনে ভূমিকাহীন মানুষদের জন্যও শোকাহত হন। আমার এক সহপাঠী বাল্যবন্ধুশিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়ে খাগড়াছড়িতে সকাল-বিকাল মদ খেয়ে চোখ লাল করে ঘুরে বেড়াতো। তার মৃত্যুতে পরিচিত এক বন্ধু খবর দিলে, ‘আমি সরাসরি বলেছিলাম যাব না’।
শিক্ষিত হয়েছিল বটে, সারাদিন-রাত মদ খেয়ে তার নিকট আত্মীয়দের পড়ালেখা করানোর নামে জেলা সদরে এনে কাজের মেয়ে বানিয়ে রেখে কিছু আত্মীয়ের স্বাভাবিক পড়ালেখার যাত্রা নষ্ট করেছিল। তাই তার মৃত্যুতে আমি যাইনি, খবরও নিইনি। আমার আরো এক নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুতে আমার উপস্থিতি অনেকে প্রত্যাশা করেছিল। এলাকায় গেলে এখনো প্রশ্ন করে ‘তোমাকে দেখলাম না কেন?’ আমার নিকট আত্মীয়রা অনেকে রাগ দেখিয়েছিল। তারপরও যাইনি।
আমার পড়ালেখার জীবনে যার কোন ভূমিকা নেই, গোষ্ঠী, সমাজ নিয়ে যে চিন্তা করতে পারেনি, তার মৃত্যূতেও যাইনি। তার একটু সহযোগিতা পেলে আমরা অনেক ভাল করতে পারতাম। কিন্তু সে সময়ে সে প্রত্যাশিত সহায়তাটুকু পাইনি। পাহাড়ে কিছু লোকের বেলায় দেখা যাবে, যাদের মরা মৃত্যুতে আমরা তাদের ভালো দিকগুলোকে নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাদের দ্বারা সমাজ কি ক্ষতিগ্রস্থ হলো আমরা ভুলেও উল্লেখ করতে চাই না। একজন গুণী মানুষকে চিনতাম সন্ধ্যা হলে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের নিয়ে দল বেঁধে উচুঁতলার ছাদে নাচগান করতেন।
তারুণ্যের শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে সমাজ সংস্কারের কাজে লাগানোর সুযোগগুলোকে তরুণদের ছাদে তুলে জোছনা রাত, রাতের তারা, উপভোগ করার মতো জমিদারি সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। সেই তরুণদের দল জমিদারি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজকে কিছু দেয়ার সুযোগকে কাজে লাগানোর বদলে গ্রামে গ্রামে বিবাদ, ঝগড়া, গ্রামে গ্রামে উন্নয়ন কমিটির নামে নতুন নতুন নেতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন। আমরা পাহাড়িরা একবাক্যে জানি কারা এবং কিভাবে স্থানীয় বাজার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক কাজকর্মে সকলের স্ফূর্তঅংশগ্রহণের ‘মালেয়া’ সংস্কৃতিকে নষ্ট করেছিল।
গুণী মানুষটি যেভাবে তার সময়কে পার করতে চেয়েছিল, সেভাবে পার করতে দিয়েছি। কিংবা গুণী মানুষের সান্নিধ্যে থেকে তরুণ শিক্ষিতের দল সময়কে উপভোগ করতে চেয়েছিল মাত্র। গুণী মানুষটির গুণকে বৃহৎ সমাজের কাজে লাগাতে তরুণরা ব্যবহার করেনি। ফলে অনেক তরুণরাও এখন সেই গুণী মানুষটিকে মডেল করে নিয়মিত ছাদ সংস্কৃতি অতি যত্নে লালন পালন করে চলেছেন। তাদের আমরা জানি, চিনি কিন্তু সমালোচনা করি না। গুণী মানুষটির মৃত্যুতে যদি এই অংশটিকেও আলোচনায় আনতে পারতাম, সমালোচনা করতাম, অনেক তরুণ নিজেদের ধরে রাখতে সচেষ্ট হতেন। ভাবতেন, তাদের সময়েও এই অধ্যায়টি উত্থাপিত হতে পারে।
ফিলিপাইনের আদিবাসী সমাজে কোন ব্যক্তির মৃত্যুতে ভালগুণগুলো স্মরণ করার পাশাপাশি তার নৈতিবাচক দিকগুলোকেও নাকি সবার সামনে তুলে ধরা হয়। তাদের বিশ্বাস, এতে সমাজের অন্যরা সর্তক হওয়ার সুযোগ পায়। কথাটি শুনেছিলাম এক ফিলিপাইনের আদিবাসী নেতার মুখে। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে পারি। আমি এখানে কিছুটা শুরু করলাম। যদি পাপ হয় আমার প্রথম হোক।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক। ইমেইল: : nyohlamong2@gmail.com