২০১৪ সালে থেকে থমকে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। চুক্তি বাস্তবায়নে গত ৮ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ স্থানীয় পর্যটনকে জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর আর কোন বিভাগ হস্তান্তর করা হয়নি।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় থমকে আছে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকার কাজ। হচ্ছে না জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন। তৈরি হয়নি আঞ্চলিক পরিষদের কার্য বিধিমালা।
স্থানীয় পুলিশকে জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরের কথা পার্বত্য চুক্তিতে উল্লেখ থাকলেও হস্তান্তর করা হয়নি। অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়নি। এমন অবস্থায় ২৫ বছরে পা রাখল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি।
চুক্তির ২৫ বছরে এসে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি ও প্রত্যাশার কথা বলেছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় পাহাড়িরা বলছেন চুক্তি পুর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলেও যতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তা থেকে সুফল পাচ্ছে পাহাড়ের মানুষ। চুক্তির পুর্ণ বাস্তবায়ন হলে এর সুফল আরো বাড়বে।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী তনয় দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চুক্তির কারণে এ এলাকাটি বেসামরিকরণ ও সংঘাত মুক্ত করা। চুক্তির কারণে কোন না কোন অগ্রগতি হয়েছে। চুক্তির কারণে ট্রাস্কফোর্স, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন হয়েছে। কিন্তু এগুলো কার্যত ভূমিকা রাখতে পারছে না। গত ২৫ বছরেও একটা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেনি কমিশন। অন্যদিকে কোন উদ্ভাস্তুকে পুনর্বাসন করতে পারেনি টাস্কফোর্স।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে গানিতিক হিসাব দেওয়া হয়। বাস্তব অর্থে এটি গাণিতিক বিষয় নয়। চুক্তির ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছে। এগুলো কতটুকু শক্তিশালী হয়েছে তা দেখার বিষয়। যেসব প্রতিষ্ঠান চুক্তির আলোকে সৃষ্টি সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। অনেকগুলো বিভাগ জেলা পরিষদগুলোর হাতে ন্যাস্ত যে পরিষদ নির্বাচিত ৩৩ জন সদস্য ১ জন চেয়ারম্যান দিয়ে পরিচালনা হওয়ার কথা।কিন্তু সেটি চলছে অন্তবর্তীকালীন পরিষদ দিয়ে। যেটি আগে ছিল ৫ জন। ২০১৬ সালে সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫ জন করা হয়েছে। এখানে সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নেই। না থাকায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পরিষদের নির্বাচন আটকে আছে। মনোনীত দলীয় ব্যাক্তি দিয়ে পরিষদ চালানো হচ্ছে। এ জেলা পরিষদ এখনো এখানকার গণ মানুষের প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি। এটি একটি দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে আছে।
চুক্তির মতে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বেসামরিকরণ এলাকা হবার কথা। কিন্তু এ চিত্র এখন বিপরীত। যেসব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা সেখানে পুন স্থাপন হচ্ছে।
আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে কিন্তু এটি কার্যত ভূমিকার রাখতে পারছে না। এ পরিষদের তিন পার্বত্য জেরা পরিষদের কার্যক্রম সমন্বয়ক করা কথা চুক্তিতে বলা আছে। কিন্তু জেলা পরিষদ আঞ্চলিক পরিষদের কথাই শুনে না।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা বলেন, এক কথায় জেলা পরিষদ শক্তিশালী নয়। পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদ মর্যাদা কি তা নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। ।
অন্যদিকে বাঙালীদের একটি অংশ বলছে চুক্তির কারণে পার্বত্য বাঙালীরা বৈষম্যর শিকার হচ্ছে। এজন্য চুক্তির কিছু বিষয় সংশোধনের দাবী এ অংশের।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালী ভিত্তিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, পার্বত্য চুক্তি পাহাড়ি বাঙালীর মধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছে। এ বৈষম্য দুর করতে চুক্তির কিছু কিছু ধারা বাতিল করা দরকার। এসব ধারার কারণে পার্বত্য বাঙালীরা বৈষম্যর শিকার হচ্ছেন। চুক্তিতে বলা হয়েছে এটি উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল কিন্তু বাস্তবে এখানে ৫৪ শতাংশ বাঙালী। তাই এ কথাটি বাতিল করে এ এলাকার বাঙালীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা দরকার। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি একজন ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা দরকার।
পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষ জনসংহতি সমিতি বলছে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় একের পর এক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।২০১৪ সালের পর থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগই চোখে পড়েনি।
সরকারের একটি পক্ষ চায় না চুক্তি বাস্তবায়ন হোক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে সাহস নিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল সে সাহস নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার ভুল পথে এগুচ্ছে। দেশের স্বার্থে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করা দরকার। পাহাড়ে এখন একাধিক দল সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। এসব দলগুলোকে এখন চুক্তি বাস্তবায়নের অন্তরায় বলা হচ্ছে। ভাগ কর শাসন কর এ নীতি অনুসরণ করতে একের পর এক দল সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান রাঙামাটি সংসদীয় আসনের সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, আসলে ২০১৪ সালের পর জেলা পরিষদগুলোর কাছে কোন বিভাগ হস্তান্তর করা হয়নি তা ঠিক। তবে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এখনো হস্তান্তর করা হয়নি সেগুলো হস্তান্তরে সরকারের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হচ্ছে।
তালুকদার আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন অস্ত্রবাজি, চাদাবাজি, খুনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও একের পর এক আঞ্চলিক দল আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এ দলগুলো পাহাড়ে অশান্তির মুল কারণ। এদের কারণে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
দীপংকর তালুকদার আরো বলেন, চুক্তির ২৫ বছর পরও নির্বাচন না হওয়ায় জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ শক্তিশালী হচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন না হবে ততক্ষণ এসব প্রতিষ্ঠানে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের শাসনতান্ত্রিক অংশিদারীত্ব অধিকার আদায়ে আন্দোলনে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)র সাথে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সরকার।
এ চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, টাস্কফোর্স গঠন হয়। চুক্তির আলোকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে অনেকগুলো বিভাগ হস্তান্তর করা হয়। তার মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য, প্রাণী সম্পদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, যুব উন্নয়ন, সমবায়, সমাজ সেবা, শিল্পকলা, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, জেলা সরকারী গ্রন্থাগার, হর্টিকালচার সেন্টার সমূহ, জেলা নার্সিং ইনস্টিটিউট, বিএনডিসি,, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, জেলা পরিবার পরিকল্পনা ও স্থানীয় পর্যটন সহ অনেকগুলো বিভাগ।
বান্দরবান জেলা পরিষদের কাছে ২৭টি , রাঙামাটি জেলা পরিষদের ৩০টি এবং খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের কাছে ৩০টি বিভাগ হস্তান্তর করা হয়।
গুরুত্বপুর্ণ বিভাগের মধ্যে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় পুলিশকে তিন জেলা পরিষদের কোনটির কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।