মাত্র আর ক’দিন পরই শুরু হবে মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব সাংগ্রাই। সাংগ্রাই মানেই মিলনমেলা ও প্রাণের উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে এরই মধ্যে পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে উৎসবের আমেজ। পুরনো দিনের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুনের আয়োজনে ব্যস্ত সবাই। বছর পেরিয়ে আবারও বর্ষবরণে প্রস্তুত এই সস্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা।
সাংগ্রাই বর্ষবরণকে ঘিরে আদিবাসী পল্লীগুলোতে নতুন জামা-কাপড় কেনা, ঘর সাজানো, যুবক-যুবতীদের সাজগোজ, পিঠা তৈরীর জন্য দল বেঁধে অর্থ সংগ্রহ করা, বিহারে ছোঁয়াং(খাবার) দান ও ফুল পূজাসহ সর্বোপরি মৈত্রী পানিবর্ষণের বাঁধভাঙা আনন্দ উচ্ছ্বাস সব মিলিয়ে এই অঞ্চলে সবকটি সম্প্রদায়ের মানুষ এখন নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ব্যাপক আয়োজন করছে।
জানা গেছে, মারমা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে মৈত্রী পানি বর্ষণ বা জলকেলি উৎসব। সকল পাপাচার গ্লানি ধুয়ে-মুছে নিতে মারমা তরুণ তরুণীরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটান, এসময় মেতে উঠেন আনন্দ-উল্লাসে। সেদিন অলিগলি থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় চলে জলকেলি উৎসব। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ এই খেলায় মেতে ওঠেন। এছাড়াও এই উৎসবকে আরো আকর্ষনীয় করতে নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরিধান করে প্রাচীন ও বিলুপ্তপ্রায় খেলাধুলায় মেতে ওঠেন তুরুণ-তরুণীরা। সেইদিন সন্ধ্যায় পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন গলিতে চলে ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরির উৎসব। সন্ধ্যার দিকে ছোট-বড়ো সবাই(বৌদ্ধ ধর্মালম্বী) বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে পূজা করেন, যে যার সাধ্যমতো দান করেন, শীল পালন করেন ইত্যাদি। সেই দিন রাত্রের দল বেঁধে পিঠা তৈরির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যুবক-যুবতীরা। এসময় নাচে-গানে এই উৎসবকে মাতিয়ে তোলেন তারা।
মারমা তরুণী অংমেসিং মারমা বলেন, ১৪ এপ্রিল বুদ্ধ স্নানের মধ্য দিয়ে আমাদের সাংগ্রাই অনুষ্ঠান শুরু হয়। একে অপরকে মৈত্রী পানি বর্ষনের মাধ্যমে আমরা নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাই। এই বছরও পরিবার, বন্ধুবান্ধব এক সাথে ” রিলং পোয়ে” বা জলকেলি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিঠা তৈরি উৎসব উপভোগ করে নতুন বছরকে বরণ করবো।
বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি অংছাইউ মারমা পুলু উৎসবকে ঘিরে তার অভিমত ব্যক্ত করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মারমা ও রাখাইন ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের মানুষের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব সাংগ্রাই। পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরনের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। রিলং পোয়ে বা মৈত্রী পানি বর্ষনের মাধ্যমে বিগত বছরের সকল গ্লানিগুলো মুছে নতুনভাবে নতুন বছর বরন হয়ে থাকে। তাছাড়া এর পাশাপাশি পাড়ায় পাড়ায় বয়স্কদের পূজা, ক্যাং এ ও ছোয়াইং, পিঠা বানানো উৎসব, ঐতিহ্য ঢোহ ও তাছি (পাহাড়ি খেলা) ইত্যাদির বর্ণালী আয়োজনে মধ্য দিয়ে উৎসবটি পালন করে আসছে।
বান্দরবান সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন কমিটির সূত্রে জানা যায়, পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণের মধ্য দিয়ে মারমা সম্প্রদায়ের আগামী ১৩ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার ) শুরু হচ্ছে বান্দরবানে তিনদিনব্যাপী সাংগ্রাই পোয়েহ্ বা জলকেলি উৎসব। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছোয়াং দান, বয়স্ক পূজা, বুদ্ধ স্নান, শীলগ্রহণ ইত্যাদি আর সামাজিক অনুষ্ঠান মৈত্রী পানি বর্ষণ, তৈলাক্ত বাঁশ আরোহণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পাহাড়ীদের ঐতিহ্য খেলাধুলা।
উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শৈটিংওয়াই মারমা বলেন, ‘মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবকে ঘিরে এরই মধ্যে সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১৩ এপ্রিল সকাল ৮টায় মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে উৎসবটির শুভসূচনা হবে। অনুষ্ঠানকে সার্থক করার জন্য সকলের কাছ থেকে সহযোগিতা কামনা করছি।’
বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানকে ঘিরে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সবধরণের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেইদিন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে। যাতে বান্দরবানে আগত দর্শনার্থীরা উৎসবটি সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে।
প্রসঙ্গত, মারমাদের ভাষায় এ উৎসবকে সাংগ্রাই, চাকমাদের ভাষায় বিজু, ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় বিসু এবং ম্রোদের ভাষায় চাংক্রান নামে আখ্যায়িত করা হয়। পাহাড়ি সম্প্রদায়ের প্রধান এই সামাজিক উৎসবকে সমষ্টিগতভাবে ‘বৈসাবি’ বলা হয়। এ সময় পাহাড়ের ভিন্নধর্মী বর্ষবরণের এই উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় হাজারো পর্যটকের আগমন ঘটে।