বরুন কুমার দত্ত। রাঙামাটি জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা। অভিযোগ আছে, এ কর্মকর্তা টাকার লোভ সামলাতে পারেন না। অঙ্ক যতই কম হোক যেখানে টাকা সেখানেই দায়িত্ব নেন তিনি।
অভিযোগ আছে, জেলার আয় বর্ধক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নিস্ক্রিয় রেখে নিজে দায়িত্ব নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মাসৎ করেন ডা. বরুণ কুমার দত্ত।
তিনি জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা হলেও হাঁস, শুকর, মুরগি খামারসহ জেলার একাধিক উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।
এসব দায়িত্ব নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষন, উন্নয়ন, পশু পাখির খাদ্য ক্রয়, বিবিধ খাতের জন্য পাওয়া সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি জেলায় দায়িত্ব নেন ডা. বরুণ কুমার দত্ত । সেদিন ডা. মনোরঞ্জন ধরের কাছ থেকে আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বও নেন বরুণ।
তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় সম্পুর্ণ সচল খামার বুঝে নেন। সে সময় হ্যাচারীর ৪ টি এসিসহ, ৩ ইনকিউবেটর (বাচ্চা উৎপাদন মেশিন) সচল ছিল। খামারের তিনটি শেডে ১ হাজার ৬৭৩ হাঁস ছিল। হ্যাচারীতে উৎপাদন হতো হাঁসের বাচ্চা।
বরুণ দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শুরু হয় হাঁস বিক্রির মহোৎসব।
তার আমলে ২০১৯ সালে জুলাইয়ে শুক্রবারের একদিনে খামারের পেছনের দরজা দিয়ে চুরি করে হাঁস বিক্রির খবর ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে প্রচার হলে বিভাগীয় তদন্ত হয়।
তদন্তের পর খামারের কোষাধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলামকে নওগাঁয় বদলি করা হয়। কিন্তু দায়িত্বে বহাল থাকেন বরুণ। বর্তমানে হ্যাচারীর সব ইনকিউবেটর ও এসগিুলো নষ্ট হয়ে গেছে। পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে হাঁস থাকার শেডগুলো। হাঁস উৎপাদন শূণ্যর কোটায়।
এমন অবস্থায় ৯৭ টি হাঁসা হাঁস, ৪৩০টি হাঁসী হাঁস ও ১,১৬৮ কেজি হাসেঁর খাবার বুঝিয়ে দিয়ে গত ২০২২ সালে ২৪ নভেম্বর কুসুম চাকমার হাতে খামারের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন বরুণ কুমার দত্ত।
খামারে খরচ সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও বরুণের বিরুদ্ধে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া খাদ্য ক্রয়ের অভিযোগ পায় প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার ৯০০ টাকার হাঁসের খাদ্য ক্রয় করেছেন বরুণ।
প্রাণিসম্পদ উৎপাদন বিভাগ বরুণকে হাসেঁর খাদ্য ক্রয়ের জন্য ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু এর বাইরে অতিরিক্ত ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৯০০ টাকার খাদ্য ক্রয় দেখান বরুণ। এ অসঙ্গতির হিসাব এক সপ্তাহের মধ্যে যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য ২০২২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর আদেশ দেন প্রাণী সম্পদ বিভাগের উৎপাদন পরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক।
এ বিষয়ে বরুণ কুমার দত্ত বলেন, খামারটি এখন পরিত্যক্ত হয়েছে। খামারের যন্ত্রপাতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এটি সংস্কারের জন্য সরকার এ যাবত কোনো বরাদ্দ দেয়নি। এখন নতুন করে শুরু করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। খামারের এ অবস্থার পেছনে আমার কোনো ব্যর্থতা নেই।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বরুণ কুমার দত্ত ২০১৮ সালে রাঙামাটি পিগ (শুকর) খামারে দায়িত্ব থাকাকালীন সময় জুলাই মাসে রাঙামাটি জেলা পরিষদ উন্নত জাতের শুকরের বাচ্চা ক্রয়ের জন্য ৩ ধাপে ৬ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়। কিন্তু বরুণ দত্ত কোনো শুকর না কিনে টাকাগুলো আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া যায়। তৎকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বৃষকেতু চাকমা।
বৃষকেতু চাকমা বলেন, আমার আমলে শুকর কেনার জন্য ৬ লাখ টাকা দিয়েছি তা সত্য। কিন্তু আমার আমলে শুকরের হিসাব দিতে পারেননি বরুণ। আমি যতদিন চেয়ারম্যান ছিলাম তার কার্যক্রম নিয়ে আমি খুব কষ্টে ছিলাম।
তার সাথে আমি এমন আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি যা পরিষদের কোনো পিয়নের সাথেও এমন আচরণ করিনি।
আমার জীবনে এমন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা দেখিনি। তাকে নিয়ে কত অভিযোগ! এগুলো বলে শেষ করা যাবে না। তাকে রাঙামাটি থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য দুই দফায় উপরে চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু বদলি করা হয়নি। আমি যতদিন চেয়ারম্যান ছিলাম, ততদিন আমি তার এসিআর এ (এনুয়েল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট) অর্থাৎ বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে কম নম্বর দিয়েছিলাম। সেই হিসাবে তার কোনো দিন পদোন্নতি হওয়ার কথা নয়।
এ বিষয়ে বরুণ কুমার দত্ত প্রতিবেদককে বলেন, আপনি ভুল শুনেছেন আপনার কাছে সব ভুয়া খবর দেয়া হয়েছে। আমি শুকর কিনেছি। শুকর কিনেছি বলে আজকে খামারটি টিকে আছে। আমার বিরুদ্ধে বৃষকেতু যে কথাগুলো বলেছেন, সেটা তার ব্যর্থতা। আমার কোনো ব্যর্থতা নেই।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি বরকল উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা. আব্দুল্লাহ আল নোমান, লংগদু উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা. সৌরভ সেন, জুরাছড়ি উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা. হারুণ অর রশীদ, বিলাইছড়ি উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. নুরুন্নবী হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা হিসাবে উপজেলার প্রশাসনিক অনুমতিসহ সব আয় ব্যয় ক্ষমতা দেয়। কিন্তু তাদের ক্ষমতা যথা সময়ে বুঝিয়ে দেননি বরুণ কুমার দত্ত।
নাম প্রকাশে অনিশ্চুক এমন এক উপজেলা কর্মকর্তা বলেন, তিনি আমাদের বস। আমরা তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না। আসলে আমাদের কিছুই করার ছিল না। সব ক্ষমতা নিজের কাছে রেখে অনিয়ম দুর্নীতি সম্পন্ন করার পর গত ১৮ জুন আমাদের প্রশাসনিক ও আয় ব্যয়ের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আমরা অনভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণ নিতে হবে- এমন কথাবার্তা বলে আমাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়।
এ বিষয়ে বরুণ কুমার দত্ত বলেন, এ ঝামেলাটি করেছে রাঙামাটি জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ ফাইলগুলো আটকে রেখেছিল। জানুয়ারিতে তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও জেলা পরিষদের গাফিলতির কারণে তা বুঝিয়ে দিতে দেরি হয়েছে। কে এ অভিযোগ করেছে তাকে তাঁর সামনে হাজির করতে বলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরুণ দত্তের কথা মতো না চললে অধস্তন কর্মকর্তাদের নানা হয়রানি করতেন। নিজের তৈরি আদেশে বদলি করান। পছন্দমতো ব্যক্তিদের নিয়ে আসেন জেলা অফিসে। শুধু বদলিতে সীমাবদ্ধ থাকেন না বরুণ। তিনি এখতিয়ার বহির্ভুত পদ পরিবর্তন করে দেন।
২০২২ সালে ২৯ ডিসেম্বর এখতিয়ার বহির্ভুত দুইজন মো. আবু তাহের ও দিপালী চাকমাকে তাদের পদ পরিবর্তন করে বদলির আদেশ দেন বরুণ কুমার দত্ত।
এ বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে বরুণের জারি করা বদলি ও পদায়নের আদেশ বাতিল করেন বরুণ কুমার। কিন্তু বরুণের বিরু্দ্ধে এ যাবত কোনো ব্যবস্থা-ই নেওয়া হয়নি। বিপরীতে হয়েছে পদোন্নতি। গত ২৬ জুন পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় বরুণ কুমার দত্তকে।
এখতিয়ার বহির্ভূত বদলির বিষয়ে বরুণ কুমার দত্ত বলেন, জেলা পরিষদের কারণে এ সমস্যা হয়েছে। এখন যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা জেলা পরিষদ সমাধান করবে।
জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ জেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত। অভিযোগ আছে, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে নিজে ফাইল নিয়ে যান বরুণ কুমার দত্ত। চেয়ারম্যানকে ভুলভাবে বুঝিয়ে কাগজে নেন স্বাক্ষর। এসব কর্মকান্ডে প্রাণী সম্পদ বিভাগের নানান জটিলতা তৈরি হয়। এসব জটিলতা নিরসনের জন্য প্রাণী সম্পদ বিভাগ থেকে একাধিকবার শোকজ নোটিশ দেওয়া হয় বরুণ কুমার দত্তকে।
জেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে ভবন সংস্কারের জন্য পাওয়া ৪ লাখ টাকার কোনো কাজই করেননি বরুণ কুমার দত্ত।
এদিকে জেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের পাশে জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের ভবনকে অফিসার ডরমেটরি নাম দিয়ে ৪ বছরের অধিক সময় ধরে বিনা ভাড়ায় বসবাস করে আসছেন বরুণ কুমার দত্ত। এখানে তিনি দুটো অপরাধ করছেন। একদিকে বিনা ভাড়ায় থাকছেন অন্যদিকে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের অফিস দখল করে অফিসের কার্যক্রমে ক্ষতি করছেন।
এর পাশে কার্যালয় বিভাগের অন্য প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য বাসভবন বরাদ্দ থাকলেও এসব বাস ভবনে তাদের থাকতে দেন না বরুন কুমার দত্ত।
এসব কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, বরুণ কুমার কার্যালয়ে অধীনস্ত এক চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক জড়িয়েছেন। এ পরিবারকে প্রথম শ্রেণী কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ থাকা বাস ভবন বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি নানান সুবিধা দিয়ে থাকেন বরুণ। ঐ নারীকে নিয়ে বরুণ দত্তকে হাঁস খামার এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর একাধিক ছবি পাওয়া যায়।
এ সব অভিযোগ অস্বীকার করে বরুণ কুমার দত্ত বলেন, আপনি যেসব অভিযোগ পেয়েছেন সবগুলো ভুয়া। এগুলো একটিরও সত্যতা নেই। বলেন, আমাকে নিয়ে আপনার এত ইন্টারেস্ট কেন? আপনি ভাবার কে? রাঙামাটিতে তো আরো অনেক সাংবাদিক আছে। সাংবাদিক নেতা আছে এদের সাথে তো আমার ভাল পরিচয়। এদের কোন খবর নেই। আপনার কেন এত ইন্টারেস্ট? আপনার আর কোন কাজ নেই? আমার অভিযোগ নিয়ে রাষ্ট্র ভাববে। আপনি ভাবার কে?
আমি গত বছর শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছি। এ বছরও আমাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
শুদ্ধাচার নীতিমালায় ৫.৬ ধারায় বলা আছে কোন কর্মচারী একবার এ পুরস্কার পেলে কর্মস্থল বদলী হলেও পরবর্তী তিন বছর পুনরায় এ পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না।এ পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট, একটি ক্রেস্ট ও এক মাসের মুল বেতনের সম পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়।
নীতিমালা ভঙ্গ করে আবার পুরস্কার চাওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ক্ষেপে যান বরুণ কুমার দত্ত। এখানে আমি একমাত্র অফিসার। আমাকে এ পুরস্কার দেওয়ার যোগ্য মনে করা হলে দেওয়া হবে।
এসব গোপনীয় তথ্য কোথায় পাইছেন? আপনাকে আমি ডিসিকে দিয়ে ডাকাব। ঢাকা চট্টগ্রামে বড় বড় সাংবাদিক আমার পরিচিত আছে। আমি এখনো সে ক্ষমতা দেখাইনি।
আমার ভালো কাজ একটি পক্ষ দেখতে পারছে না, সেজন্য এসব অভিযোগ করছে। আমার বিরুদ্ধে অনেক জায়গায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি বরং আমার প্রমোশন হয়েছে। আমি কোনো অনিয়মের সাথে জড়িত নই।
আমি কাউকে ডরমেটরিতে থাকার ব্যবস্থা করিনি এবং বাধাও সৃষ্টি করিনি। কারণ জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তাদের থাকার জন্য কোনো ডরমেটরি নেই। এমনকি আমারও থাকার জন্য আবাসন নেই।
এসব বিষয়ে রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, বরুণ কুমার দত্তের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ তা আমার আগে জানা ছিল না। এখন তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ পাওয়ার পর আমি এখন তার দপ্তর থেকে আসা যে কোনো ফাইল অধিকতর যাচাই বাচাই করার পর স্বাক্ষর করি।