পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির জন্য মৌসুমী বৃষ্টিপাত যেন ধাতব মুদ্রার দুই পিঠ। এর একদিকে জলাবদ্ধতা, পাহাড়ধস ও প্রাণহানীর শংকা-ভয়। অন্য পাশটায় উৎপাদন আর রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধি। কয়েক মাস ধরে কাপ্তাই হ্রদে চলছে পানিস্বল্পতা। বৃষ্টির অভাবে হ্রদের ওপর নির্ভরশীর বিদ্যুৎ উৎপাদন, মৎস্য উৎপাদন ও জেলা সদরের সঙ্গে ৭ উপজেলার নৌ-যোগাযোগ ঠেকে তলানীতে। এখন বদলেছে সেই দৃশ্য। গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা ৬ দিনের হালকা-ভারি বৃষ্টিতেই কাপ্তাই হ্রদ এখন ভরপুর নীল জলরাশিতে। তাই পূর্ণ গতিতে চলছে উৎপাদন আর যোগাযোগের চাকা।
কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর বেড়ে যাওযায় রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে অবস্থিত দেশের একমাত্র কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৬ গুনের বেশি। দৈনিক ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রের ৫টি ইউনিট হতে ১৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে। উৎপাদিত এই বিদ্যুতের পুরোটাই জাতীয় গ্রীডে সঞ্চালন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী এটিএম আব্দুজ্জাহের।
এর আগে পানিস্বল্পতায় এক এক করে কেন্দ্রের ৪টি ইউনিট বন্ধ করে দেন কর্তৃপক্ষ। তবে নিম্নমুখী উৎপাদন নিয়েই এক নম্বর ইউনিট সচল রাখা হয়। তবে সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল ওই ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন ঠেকেছিলো মাত্র ২৫ মেগাওয়াটে। অবশ্য মাঝে সামান্য পরিমানে বৃষ্টি হওয়ায় গত ২২ জুন বিদ্যুৎ উপৎপাদন ২৫ থেকে বেড়ে ৬০ এবং ২২ জুলাই ৬০ থেকে বেড়ে ৭০ মেগাওয়াটে পৌছে। আর এর দেড় মাসের মাথায় আজ এই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭০ মেগাওয়াট।
কাপ্তাই লেকে পানির ধারনক্ষমতা ১০৯ ফুট এম এস এল। পানির পরিমাপক-রুলকার্ভ অনুযায়ী এ সময়ে হ্রদে পানি থাকার কথা ৯০.৬০ ফুট। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এই পানির পরিমাণ ছিল ৯১.০০ ফুট।
মূলত অনাবৃষ্টি আর প্রচন্ড তাপদাহে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ কমে গিয়েছিল। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিল দেশের মিঠা পানির গুরুত্বপূণ মৎস্য ভান্ডার কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য উৎপাদনেও। সাধারণত মাছের প্রজনন মৌসুমে ১ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৩ মাস কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার বন্ধ থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এই মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ১০ দিন এগিয়ে এনে গত ২০ এপ্রিল থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ৩ মাস মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয় জেলা প্রশাসন। তারপরও কাংখিত বৃষ্টিপাতের দেখা না মেলায় ওই নিষেধাজ্ঞা আরও একমাস বাড়িয়ে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে।
পানিস্বল্পতায় রাঙামাটি জেলা শহরের সঙ্গে বাঘাইছড়ি, কাপ্তাইসহ ৭ উপজেলায় বন্ধ হয়ে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল। এতে যাতায়াতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ৫ লাখেরও বেশি মানুষ। ৫৩টি যাত্রিবাহী লঞ্চ ও ৩’শটি বড় ইঞ্জিনবোট বন্ধ হওয়ায় নৌযান মালিকদের দৈনিক ক্ষতি হয়েছে ১২ লাখ টাকার বেশি। আয় বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েন পাঁচ হাজার নৌযান শ্রমিকও।
এসময় বিকল্প হিসেবে ইঞ্জিন চালিত ছোট দেশীয় নৌকায় চড়ে অথবা পায়ে হেঁটেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে দুর্গম উপজেলাবাসীকে। পণ্য পরিবহনেও বেড়েছিল কয়েকগুণ খরচ আর দুর্ভোগ। এতে বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দামও। পর্যটন ও ব্যববসা বাণিজ্যেও পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব। তবে আশার কথা টানা বৃষ্টিপাতে এরইমধ্যে কাপ্তাই হ্রদে পর্যাপ্ত পানির যোগান হয়েছে।
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী এ টি এম আব্দুজ্জাহের জানিয়েছেন, ‘উৎপাদিত এই বিদ্যুতের পুরোটাই জাতীয় গ্রীডে সঞ্চালন করা হচ্ছে। গত কয়েক দিনের অতিবৃষ্টি এবং পাহাড়ী ঢলের কারণে কাপ্তাই হ্রদে পানির পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির পরিমাণ বাড়লে বিদ্যুতের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে’।