ঘড়ির কাটায় বেলা তখন সাড়ে তিনটা। রাঙামাটির ঘাগড়া থেকে বের হওয়া বর্ণাঢ্য মোটর শোভাযাত্রার মধ্যমণি সাফজয়ী পাহাড়ের পাঁচ ফুটবলাকন্যা ঋতুপর্ণা, রূপনা, মনিকা, আনাই আর আনুচিং। রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক ক্রীড়ামোদি মানুষ ব্যক্তিগত যান নিয়ে দিয়েছেন সঙ্গ। চলছে বাঁশি-ঢোলের নাচন।
টেলিভিশনে আর খবরের কাগজে দেখা নিজেদের সেই পাঁচ নারী ফুটবলারদের এক নজর দেখে উচ্ছসিত রাঙামাটির মানুষ। সড়কের দুপাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত নেড়ে জানিয়েছেন শুভেচ্ছা বার্তা। রাঙামাটি স্টেডিয়ামে এসে থামে শোভাযাত্রা। সেখানে আগ থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন বিপুলসংখ্যক শুভাকাঙ্খী। বিকেল পৌণে পাঁচটায় রাঙামাটি চিংহ্লামং মারী স্টেডিয়ামে আয়োজিত রাঙামাটি জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন তারা।
সাফজয়ী পাঁচ নারী ফুটবলারের প্রত্যেককে রাঙামাটি জেলা পরিষদ থেকে দুই লাখ করে মোট ১০ লাখ টাকা অর্থ পুরস্কার, ক্রেস্ট আর শিক্ষক বীরসেন চাকমা ও স্কুল কোচ শান্তিময় চাকমার হাতে নগদ টাকা ও ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়েছে।
রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার ও উন্নয়নবোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা দিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা করে। এছাড়া সেনা রিজিয়ন, বিজিবি সেক্টর, জেলা পুলিশ ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও রাঙামাটি পৌরসভা পক্ষ থেকে ক্রেস্ট দেয়া হয়েছে।
মঞ্চে নিজের জেলাবাসীর কাছে জমকালো সংবর্ধণায় মুগ্ধ আর কৃতজ্ঞতা জানালেন ঋতুপর্ণা চাকমা । বললেন, পাহাড়ে আরও প্রতিভাবান নারী খেলোয়াড় তৈরী হতে ভালো পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। একইসাথে নিজেদের স্কুলের জাতীয়করণ করার দাবী জানিয়েছেন তিনি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সন্তানদের অসাধারণ সাফল্য অর্জনে গর্বিত সংবর্ধণা আয়োজক কর্তৃপক্ষও। নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে আবাসিক ক্রীড়া স্কুল গড়ার ঘোষণা দিলেন জেলা পরিষদের চেয়াম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী। ঘোষণা দেন খুব শিগগিরই কাজ শুরুর।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার। বিশেষ অতিথি ছিলেন সেনা রিজিয়ন কমান্ডার, বিজিবি সেক্টর কমান্ডার, জেলা পুলিশ সুপার। এসময় ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর নৃত্য পরিবেশনার পরে পাঁচ নারী ফুটবলার ও দুই কোচের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধারা হয়।
বুধবার রাত আটটার দিকে প্রায় তিনমাস পর চার সতীর্থ ফুটবলকন্যা রূপনা, মনিকা, আনাই আর আনুচিংকে নিয়ে বাড়ি ফিরেন ঋতুপর্ণা চাকমা। খবরটি চাওর হতেই ঋতুর গ্রামের সড়কে মঘাছড়ির মুখে দলে দলে দূর দূরান্ত থেকে স্বজন, শুভাকাঙ্খিরা ভির করেন তাদের বরণ করতে, একনজর দেখে নিতে।
দেশবিদেশে আলো ছড়ানো এই পাঁচ নারী ফুটবলার তৈরির কারিগর বীরসেন চাকমা, স্কুল কোচ শান্তিময় চাকমা নিজে হাজির হয়েছিলেন তাদের বরণ করতে। ফুল আর আতশবাজি ফুটিয়ে চলেছে আয়োজন। গ্রামীণ পাহাড়ি সড়কের দুইপাশে জ্বালানো মশালের আলোয় ফিরেন ঘরে। চোখের সামনে নিজেদের ফুটবলকন্যাদের দেখে উচ্ছসিত গ্রামবাসী।
পাহাড়ে নারী ফুটবলের আতুরঘর রাঙামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়। যেখানে ফুটবল দুনিয়ায় হাতেখড়ি হয়েছে ঋতুপর্না, রুপনা, মনিকা আর দুই সহোদরা আনাই ও আনুচিং মগিনীর। সাফ জয়ের পর বৃহস্পতিবার সকালে প্রথম ফিরেছেন নিজেদের সেই স্কুলে। শিক্ষকদের ফুলেল অভ্যর্থণা আর মিষ্টিমুখ করার আতিথেয়তায় মুগ্ধ তারা। এরপর সকাল দশটায় যোগদেন ঘাগড়া সেনাজোনের সংবর্ধণায়।
ঋতুপর্ণা, মনিকা ও রূপনা চাকমাদের এই দেশজোড়া সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক নাপাওয়ার গল্প। তাই ক্রীড়াঙ্গনে ঋতুপর্ণা রূপনাদের উত্তরসুরি তৈরীর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুযোগ আর পরিচর্যা। ভালো পৃষ্টপোষকতা পেলে পাহাড়ে আরও প্রতিভাবান নারী খেলোয়াড় উঠে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের।