‘শিশুদের মন রক্ষা করা রাজার পক্ষেও সম্ভব নয়’ বলে ছেলেবেলায় মারমাদের একটি গল্প শুনেছি। একদিন রাজা কথাটি শুনে নাকি খুব রেগে গিয়ে আদেশ করলেন, “কে বলেছে সে কথা? আমার কাছে নিয়ে আস, শিশুর সকল ইচ্ছা পূরণ করে দেখাব”। রাজা তার প্রতিজ্ঞা মতো একদিন এক শিশুকে সকল ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করতে থাকলেন। যা খেতে চায় দিলেন, সেদিকে যেতে চায় যেতে দিলেন, এভাবে চলতে চলতে একসময় শিশুটি একটি খালি বোতল দেখে নাকি বোতলের ভিতরে ঢুকতে চাইলো। রাজা ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। গল্পটি অন্য কোন সমাজে প্রচলন আছে কিনা যাচাই করিনি কিংবা কোন বইয়ের গল্প কিনা তাও আমার জানা নেই। তবে শিশু সংশ্লিষ্ট এমন কিছু গল্প শুনে বড় হয়েছি।
আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। বাবার হাত ধরেই স্কুলে যাওয়া আসা শুরু। সেই থেকে বন্ধুর অভাব কখনো হয়নি। আমাদের সময়ে স্কুল মানে দুই-তিনটি মাত্র বই আর ৯-৪টা পর্যন্ত স্কুলে কাটানো। ক্লাশের চেয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে খেলাধুলা, হৈ-হুল্লোড় মধ্যেই কাটে। আমাদের সময়ে স্কুল মানে মাছের বাজার, চেঁচামেচি, চিল্লাপাল্লা। অনেক দূর থেকে স্কুলের উপস্থিতি ঢের পাওয়া যেতো। আর এখন শহরের স্কুল মানে নিরবতা, অনেকটা ‘মুরগি ফার্মের’ মতো। স্কুলে ঢুকে না পড়লে বুঝা যায় না।
স্কুলে যাই পড়ানো হোক, দিনের আলোতে কোন পড়ালেখা করতাম না। সন্ধ্যা নামলেই কেবল পড়তে বসতাম। আমাদের সময়ে পড়ালেখা বাদেও পরিবারের সকল কাজে সহযোগিতা করাই ছিল শিশুর কাজ। সেই থেকে এমন কোন কাজ নেই মা-বাবা করাননি। দূর গ্রামে থাকা জমিতে চড়ুই পাখি তাড়ানোর কাজ থেকে শুরু করে হালচাষ, ধান কাটা, বাজারে ফসল বিক্রি করা কোনটাই বাদ যায়নি।
আমি অনেক লেখায় বলেছি, বাবাকে কোনদিন স্কুলে না গিয়ে ঘরে বসে ছুটি কাটাতে দেখিনি। কোন অভিভাবককে শিশুর জন্য অভিযোগ দিতে দেখিনি। বরং স্কুল সময় হলে পড়া-এলাকার শিশুদের ডেকে ডেকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। শাসনও করতেন। দুর্বল ছেলেমেয়েদের যত্ন নিতেন। বাবাকে কোনদিন শিশুর অভিভাবককে অভিযোগ দিতে ডেকে পাঠাতে দেখিনি। এখনকার স্কুলের খুব কম অভিভাবকে পাওয়া যাবে, যাকে স্কুলের শিক্ষকের উপদেশ শুনতে হয়নি। এখনকার শিক্ষকরা শিশুদের পানির বোতলের ন্যায় দেখতে চায়। কোন নড়াচড়া করবে না। আমরা ফার্মের মুরগি খেতে খেতে ‘ফার্মের শিশুই’ প্রত্যাশা করি। একটু দেশি মুরগির ন্যায় নড়াচড়া, লাফালাফি, ডাকাডাকি শুনলে, দেখলে অভিভাবকদের অনেক উপদেশ শুনতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি ছাত্রের চেয়েও বেশি পরিমানে বই চাপিয়ে দিয়ে, শিক্ষকরা বলেন ‘আপনার শিশুটি অনেক দুর্বল, পড়ালেখায় পিছিয়ে’। আমরা অভিভাবকরা ভয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি না। বলতে পারি না ‘পিছিয়ে আছে কে? আমরা নাকি শিশুরা?’
চাকরি করতে গিয়ে পাহাড়ে তিন জেলায় ভাড়া বাসার আশপাশের সকল শিশুদের সাথে ছিল আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। রাঙামাটিতে চুমুই, পূজ্যরাতো বাড়িতে মজার কিছু রান্না হলে আমাকে না দিয়ে খেতোই না। তাদের ভালোবাসায় নিজেকে কখনো একা মনে হয়নি। সময়গুলো আনন্দে, ডাকাডাকি আর ঝগড়া করে কাটিয়েছি। তারা যেমন আমাকে না ডেকে থাকতে পারতো না, আমিও তাদের সাথে যোগাযোগ না করে দিন পার করতে পারতাম না। আমার গ্রামের সকল ছেলেমেয়ে আমার ভাগিনা। দেখলে মামু বলে ডেকে কিছু একটা বলবেই।
ঢাকা শহরে সমাজ নেই। ঢাকা একটা সমাজবিহীন শহর। এখানে একই বিল্ডিং এ থাকি, লিফটে দেখা হয় কিন্তু কথা হয় না। পাশের ফ্লাটের শিশুদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি, জমে না। অভিভাবকরা জমতে দেয় না। সারাক্ষণ বইয়ে ডুবে থাকতে দিয়ে রোবট বানিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। শিশুরা স্কুল থেকে কোন পুরস্কার আনতে পারলে অভিভাবকরা গর্ব করে তখনই শুধু পুরস্কারটি দেখাতে নিয়ে আসেন। আমাদের নামকরা স্কুলগুলোও কেমন! ভাল রেজাল্ট করলে পুরস্কার হিসেবে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রের হাতেও ট্যাব দেয়। বই, খাতা, কলম পুরস্কারের তালিকাতে নেই।
শিশুদের সাথে খেলা করার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকি। তাদের মধ্যে মারপ্যাচ নেই। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাগরিক। তাদের চিন্তার ক্ষেত্র বিশাল, খোলা। শেখার, জানার জন্য সব সময় প্রস্তুত। আমরা বুড়োরা কোন কিছু জানা হয়ে গেলে, নতুন কোন জ্ঞান আর নিতে পারি না। আমারতাই ঠিক।
সম্প্রতি বন্ধুর সাথে একটি রিসোর্টে বেড়াতে গিয়ে বন্ধু’র সহকর্মী সন্তানদের কয়েকজনের সাথে সারাদিন সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। প্রথম দেখাতে এক শিশু বলে, ‘সাইকেল চড়তে চাই’। আমি বলি ‘সাইকেল চড়াবো, কিন্তু আমাকে ওস্তাদ মানতে হবে’। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে ওস্তাদ বলে ডাকা শুরু করে দেয়। ছেলেবেলায় শাহিনের কাছে সাইকেল চালনা শিখেছি। তার মা ছিলেন সরকারি হাসপাতালের আয়া। শর্ত ছিল যেখানে দেখা হবে ওস্তাদ বলে ডাকতে হবে। আমি মেনে নিয়ে তার কাছে শিখেছিলাম। আমি মহালছড়ি গেলে দেখা হলে এখনো ওস্তাদ বলে ডাকি। সেই থেকে সাইকেল প্রসঙ্গ আসায় ওস্তাদ ডাকতে হবে বলে মজা করেছিলাম। তারা আমায় সারাদিন ওস্তাদ সম্বোধন ছাড়া কোন কথাই বলেনি। তারা বলে ওস্তাদ পাতা কুড়িয়ে দাও (হরিণদের খাওয়ানোর জন্য), ওস্তাদ দোলনা ঠেলো, ওস্তাদ আমাকে নামাও ইত্যাদি। একজনের কাজ শেষ না হতেই আরেকজন ডেকে উঠে ‘ওস্তাদ, এদিকে আসেন’। ওস্তাদ ডাক শুনে অন্য ভিজিটররা আমার দিকে তাকায়। ওস্তাদরা একটু আড়াল হলে আমিও জোর গলায় ডেকে উঠি ‘ওস্তাদ’। অন্যরা কৌতুহল দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
অনেক বছর পর মনে হলো দিনটা সুন্দর কাটিয়েছি। ওস্তাদদের থেকে শিখেছিও অনেক। তারা এখন যা জানে আমি দশম শ্রেণিতেও ততটা জানতাম কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তারা এক একজন নানা বিষয়ে পারদর্শী। নতুন একটি বই ‘আরব্য রজনী’ পড়বো বলে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম, খুলে দেখার সুযোগ পাইনি। তবে ওস্তাদদের থেকে যা জেনেছি, শিখেছি তা কোন অংশে কম নয়।
তাদের জানার আগ্রহ প্রবল। বুড়োরা শুধু ঘুরে বেড়াতে, ছবি তুলতে, সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায়, পেট ভরে খেতে চায়। আর শিশুরা যা দেখে প্রশ্ন করে। নিজে নিজে উত্তরও তৈরী করে। আমরা শিশুদের আগামীর ভবিষ্যৎ বলে অনেকটা দূরে রাখি। শুধু শেখাতে চেষ্টা করি। তাদের থেকে শেখার চেষ্টা করি না। তাদেরকে আজ ও আগামীর নাগরিক বলি না।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক বক্তৃতায় (২০১৯) শুনেছি, “একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় গুণ হলো ছাত্রকে সময় দিতে পারা, নিজের কথা ছাত্রের কাছে পৌঁছাতে পারা, —ছাত্রকে ক্রিয়েটিভ হতে সমস্ত রকম সুযোগ দিতে পারার মাঝে শিক্ষকের সফলতা নিহিত”। একইভাবে জসীম উদদীন তাঁর ‘জীবন কথায়’ লিখেছেন, “ক্লাসে আমিই ছিলাম সবচাইতে ইংরেজিতে কাঁচা। তাই তিনি (বাবু বসন্ত কুমার দাস) আমাকেই সবচাইতে বেশী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করিতেন। তিনি বলিতেন “জসীম উদদীনকে যদি শিখাইতে পারি তবে ক্লাশের সব ছেলেকে শেখানো যাইবে” (দেখুন: পৃষ্ঠা ২০০)।
আমরা মেয়েছেলেকে নামী-দামী স্কুলে পড়ানোর প্রতিযোগিতা করি। যারা সারাদিন এই শিশুদের নিয়ে থাকেন, তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ আছে কি? তাদের মাঝে শিশুদের শেখানোর বদলে, শিশুদের থেকে শেখার, শিশুদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যোগ্যতা রাখেন কি? আমার এই ওস্তাদদের কথা অনেকদিন মনে থাকবে। এই ওস্তাদদের অনেক প্রশ্নের উত্তর তাদের মতো করে দিতে পারিনি। শিশুদের সাথে থাকা, গঠনমূলক সময় দেয়া সত্যিই এক কঠিন কাজ। তাই উন্নত বিশ্বে নাকি সেরাদের সেরাদেরকেই কেবল পাঠানো হয় শিশু শ্রেণিতে।
আমার পড়ালেখা শেষ হলে বাবা বলেছিলেন, “আমার মতো যদি শিক্ষকতা করতে পারো শিক্ষক হবে, নয়তো দরকার নেই”। স্কুল-কলেজে শিক্ষক হওয়ার অনেক সুযোগ এসেছিল, বাবার কথা মনে গেঁথে থাকায় কোনদিন সাহস দেখাইনি। আইরিশ শিল্পী স্টেসিয়া টসচার (Stacia Tauscher)নাকি বলেছিলেন ( ” we worry about what a child will become tomorrow, yet we forget that he is someone today”)“একটি শিশু আগামীকাল কি হবে আমরা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, অথচ আমরা ভুলে যাই সে আজকেও কেউ একজন”।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক। ইমেইল: nyohlamong2@gmail.com