একটি সুন্দর বাড়ি আর দিন শেষে মাথা গুজবার মতো একটুখানি নিরাপদ আশ্রয় -নুন আনতে পান্তা ফুরানো পরিবারের মানুষদের কাছে কেবলই অলীক কল্পনা। তাদের শিশুরা পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠবে, যেখানে থাকবেনা বিদ্যুৎ আর পানির কোনোরকম সংকট -এমন একটি পাঁকা ঘর কিংবা ফ্ল্যাটে থাকবার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না দরিদ্রপীড়িতরা। তবে এবার খাগড়াছড়ির এমন অসহায় ও দুস্থ কিছু পরিবারের চিরকালীন আক্ষেপ ঘুচাতে যাচ্ছে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আবাসন প্রকল্প’। পাহাড়ের সবুজ শ্যামলীমায় গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন ভবনে চিরস্থায়ীভাবে ঠাঁই হতে চলেছে অহসায় পরিবারগুলোর। যেখানে মানসম্মত আবাসনের পাশাপাশি পানি ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সুবিধা পাবে তাঁরা। একইসাথে সুযোগ করে দেয়া হবে সন্তানদের শিক্ষা ও নারীদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির। পাহাড়ি, বাঙালি, হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের মানুষের সম্মিলনে একটি বিভেদ-বৈষম্যহীন আবাসন হবে এখানে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ সেক্টর প্রকল্প (ইউজিপ-৩) এর আওতায় খাগড়াছড়ি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের শালবন এলাকায় দৃশ্যমান হয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আবাসন প্রকল্পটি। এতে যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ওপিইসি ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) এবং বাংলাদেশ সরকার (জিওবি)। যার চুক্তিমূল্য ছিল ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ২ হাজার ৪২৪.২৭ টাকা। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে খাগড়াছড়ি পৌরসভা।
ভূ-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাঁচ একর ভূমির ওপর দ্বিতল বিশিষ্ট চার ইউনিটের পনেরোটি আবাসিক ভবন তৈরি করা হয়েছে জেলা শহরের অদূরে শালবনে। প্রতিটি ভবনে রয়েছে চারটি করে ফ্ল্যাট। একেকটি ফ্ল্যাটের আয়তন ৫০১ বর্গফুট। সেই ফ্ল্যাটে রয়েছে একটি বৈঠকখানা-খাবার ঘর, দুটি শোবার ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি শৈচাগার। আর প্রতিটি ফ্ল্যাট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৫ লাখ ২৭ হাজার ১৫১ টাকা। উপকারভোগী পরিবারগুলোর যোগাযোগ সুবিধার্থে এই আবাসনে নির্মাণ করা হয়েছে ১৫০০ মিটার এপ্রোচ রোড। জরুরী পানির প্রয়োজনে ভবনের পাশেই প্রস্তুত করা হয়েছে একটি ওয়াটার বডি (চারপাশ আরসিসি করা পুকুর)। এছাড়াও একতল বিশিষ্ট একটি অফিস কক্ষ এবং পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য এখানে তৈরি করা হয়েছে একটি কমিউনিটি স্পেস। সব ঠিক থাকলে আগামী সাত দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রকল্পটি উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। আর উদ্বোধনের পরপরই ফ্ল্যাটে উঠতে পারবে চূড়ান্তভাবে বাছাইকৃত উপকারভোগীরা।
খাগড়াছড়ি পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘২০২১ সালের ১৪-ই ফেব্রুয়ারী এই প্রকল্পের কাজ শুরু করার পর শেষ হয় গেলো বছরের ৩১-শে ডিসেম্বর। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তা পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড কনসোটিয়াম লিমিটেড। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা।’
খাগড়াছড়ি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল করিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় গৃহহীন ও ভাসমান মানুষদের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এখানে খাগড়াছড়ি পৌরসভার বিভিন্ন এলাকার ৬০টি গৃহহীন পরিবারের ঠাঁই হতে যাচ্ছে।’
খাগড়াছড়ি নগর সমন্বয় কমিটির (টিএলসিসি) সদস্য ও জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এটি মানবিক এবং প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। তবে এর সুষ্ঠু বন্টন হওয়াটাও জরুরী। প্রত্যাশা থাকবে প্রকৃত দুস্থ ও গৃহহীনরা এর উপকারভোগী হবেন। ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম কাম্য নয়।’
খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, ‘উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আশাকরি এক সপ্তাহের মধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন।’
উপকারভোগীদের চূড়ান্ত করা প্রসঙ্গে এবং তাদের জন্য আয়বর্ধক কোনো প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে কী না-এমন প্রশ্নের উত্তরে পৌর মেয়র বলেন, ‘কারা কারা এখানে বসবাসের সুযোগ পাবেন তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। পৌরসভার সকল কাউন্সিলর ও টিএলসিসি সদস্যদের নিয়ে যাচাই-বাছাই করছি। একেবারেই গৃহহীন এবং হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে আমরা চূড়ান্ত করবো। এছাড়া বিদ্যালয়ের বাইরেও আবাসনে উপকারভোগী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার জন্য পৌরসভা থেকে একজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। পাশাপাশি নারীদের জন্য আমরা সেলাইসহ অন্যান্য কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাবছি। এজন্য সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন।’
প্রতিবেদক- খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, দৈনিক খবরের কাগজ।