দশম থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে চ্যালেঞ্জ আর ঝুঁকি নিয়েই নির্বাচনের মাঠে ছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে খোদ প্রধানমন্ত্রীর জনসভা বানচালের সহিংস চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলো প্রসিত খীসা’র নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’। তখন তারা কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে পর্যুদস্ত করতে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের পথেও ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো। বাধা না মেনে নৌকায় ভোট দেয়ায় নির্বাচনের পর পর পানছড়িতে আওয়ামীলীগ সমর্থক নবরঞ্জন কার্বারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো।
২০১৭ সালে প্রসিত খীসা’র নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে ইউপিডিএফ’র ভাঙ্গন ঘটে। আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ’র নামের আরেকটি দলের।
এই নির্বাচনে বিএনপি’র পাশাপাশি তারাও (ইউপিডিএফ-প্রসিত) মাঠে প্রতিদ্বন্ধীতায় ছিলো।
আর সদ্য সম্পন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের অক্ষমতায় প্রার্থী দিতে না পারলেও সর্বাত্মক ভোট বর্জনের পাশাপাশি ভোট প্রদানে বাধা দেয়ার সাথে সাথে সশস্ত্র হুমকি দেয়ার অভিযোগও প্রকাশ্যে আসে।
কিন্তু পোঁড়খাওয়া রাজনীতিক এবং শান্তিতে বিশ্বাসী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এবারও শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে দুই লক্ষ বিশ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে টানা তৃতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
খাগড়াছড়ির বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও নারীনেত্রী কালিন্দী রানী চাকমা জানান, তিন দশকের বেশি সময় ধরেই কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ একজন কর্মী-সংগঠক ও নেতা হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছেন। সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান এবং সকল সম্প্রদায়ের মাঝে ভারসাম্য বিধানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য বকুল চাকমা বলেন, ২০০১ সালে সারাদেশের মতো খাগড়াছড়িতে দু:শাসন নেমে আসলে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা শক্ত হাতে দলের হাল ধরেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই খাগড়াছড়িতে আওয়ামীলীগ এখনো সাংগঠনিক এবং ঐক্যবদ্ধতার জায়গায় অনেক দৃঢ়তার সাক্ষ্য বহন করছে।
খাগড়াছড়ির প্রবীন সাংবাদিক তরুণ কুমার ভট্টাচারিয়া জানান, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বাইরেও কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে শিক্ষা ও সামাজিক কল্যাণে একজন দানশীল ব্যক্তিত্বহিসেবে সুখ্যাত। ১৯৯৮৯ সালে ‘খাগড়াছড়ি স্থানীয় সরকার পরিষদ’-এ সদস্য নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে তিনি জনপ্রতিনিধিত্বে আত্মপ্রকাশ করেন। সেই থেকে ২০১১ সালে ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ’-এর চেয়ারম্যান হন। এরপর দশম সংসদ থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত তিনি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই অসীম গ্রহণযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আসছেন।
২০১৭ সালের শেষ দিকে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়ে ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ সম্পর্কিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি টাস্কফোর্সের পঞ্চম চেয়ারম্যান হিসেবে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে মন্ত্রী করার দাবী দীর্ঘদিনের এমন কথা জানিয়ে খাগাড়ছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, নানা প্রতিকুলতাকে মোকাবেলা করে তিনি বারবার খাগড়াছড়ি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি অনেক উদার। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেকে খাগাড়ছড়ির সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য উজার করে দিয়েছেন। খাগড়াছড়িতে উন্নয়নসহ সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাহসী ভুমিক রেখেছেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। সর্বোপরি দীর্ঘদিন ধরে খাগাড়ছড়ি মন্ত্রী বঞ্চিত। তাই আমি মনে করি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে মন্ত্রী করার মাধ্যমে খাগাড়ছড়িবাসির দীর্ঘদিনের দাবীর বাস্তবায়ন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পাদক ফজলে এলাহী বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি মন্ত্রিত্ববঞ্চিত। পরপর দুইবার বান্দরবানের সংসদ সদস্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার পাহাড়ের উন্নয়ন বৈষম্য দূর করতে হলে রাঙামাটি কিংবা খাগড়াছড়ি থেকে একজনকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া উচিৎ। সেদিক থেকে নানান ঘটনা প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ খাগড়াছড়ি। দুই যুগ ধরে বঞ্চিত খাগড়াছড়ি আসন থেকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া যেতে পারে। আর না হয় রাঙামাটি।
বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি সুশীল জীবন ত্রিপুরা বলেন, দীর্ঘ দুই যুগের মতো খাগড়াছড়ি মন্ত্রীত্ব বঞ্চিত। নানা কারনে গুরুত্বপুর্ণ খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে মন্ত্রী করা এখন সময়ের দাবী। তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি সহ অধিকাংশই ইস্যুই খাগড়াছড়ি কেন্দ্রীক। ফলে খাগড়াছড়ির নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী করা হলে তার পক্ষে কাজ করা অনেক সহজ হবে।
খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাব সভাপতি জীতেন বড়ুয়া মনে করেন, অপর দুই পার্বত্য জেলার চেয়ে খাগড়াছড়ি জেলার রাজনীতি অনেক বেশি সংবেদনশীল। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার নেতৃত্বকালীন সময়ে জাতি-ধর্ম এবং দল নির্বিশেষে একটি সুন্দর সহাবস্থান টিকেছিলো। সেই অর্থে তিনি পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলে উন্নয়নের ন্যায্যতা এবং সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে খাগড়াছড়ির গুরুত্ব বেশি মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট নাছির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে একই মন্ত্রী থাকাতে উন্নয়ন কর্মকান্ড এক জেলা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, অস্ত্র সমর্পনসহ সহ নানা কারনে খাগাড়ছড়ি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ তাই এ জেলাকেও বিবেচনা করা উচিৎ।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির আলোকে ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় গঠনের পর খাগাড়ছীড়র তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রয়াত কল্প রঞ্জন চাকমাকে ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়। এরপর রাঙামাটির এমপি দীপঙ্কর তালুকদার এবং বান্দরবানের এমপি বীর বাহাদুর-ই তিন পার্বত্য জেলার বিশেষায়িত এই মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তার মানে টানা দুই দশক ধরেই খাগড়াছড়ি থেকে এমপি নির্বাচিত হলেও মন্ত্রীত্ব পাননি কেউ-ই। সেদিক থেকে এবার কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে মন্ত্রী করার দাবী অনেক বেশী জোড়ালো।