প্রাইমারি স্কুল যেখানে শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরু। আর সেখানটাতেই যদি পড়া লেখা নিয়ে হয় লুকোচুরি, তাহলে শিশুদের আর শেখার জায়গাটি কোথায়? প্রশ্ন অভিভাবকদের।
বলা হচ্ছে, রাঙামাটির লংগদু উপজেলাধীন আটারকছড়া ইউনিয়নের উত্তর ইয়ারিংছড়ি (উল্টাছড়ি) সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা।
স্কুলটিতে সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল চলাকালীন সময়ে প্রধান শিক্ষক আর সাথে তিনজন সহকারী শিক্ষক বসে গল্প করছেন। সাংবাদিক এবং জনপ্রতিনিধিদের দেখে সহকারী তিনজনই কাগজ কলম হাতে নিয়ে অফিসেই লেখালেখির কাজ শুরু করে। প্রধান শিক্ষক চুপটি মেরে বসে থাকে।
প্রধান শিক্ষক রমেন চাকমার কাছে স্কুলে চলাকালীন সময়ে ক্লাস রুম তালা ঝুলানোর বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি বলেন, কই তালা মারা। ক্লাস রুম খোলা আছে কিনা দখতে চাইলে বলেন, ছাত্র ছাত্রী নাই তালা খুলে কী হবে। প্রধান শিক্ষকের কাছে ঐদিনের ছাত্র ছাত্রী হাজিরা এবং শিক্ষক হাজিরা খাতা দেখতে চাইলেও দেখাতে ব্যর্থ হন। প্রধান শিক্ষক এক সহকারী শিক্ষককে দেখিয়ে বলেন- তোমার কাছে খাতা। জবাবে ওই সহকারী বলেন খাতা তো আপনার কাছে। পরবর্তীতে কেউ আর দেখাতে পারেনি।
এছাড়াও অফিস কক্ষেই সিগারেট(ধুমপান) করার বিভিন্ন আলামত পাওয়া যায়। এবিষয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি চুপ করে থাকেন। অফিসে বসে দাবা খেলা, তামাক খাওয়া নিত্য দিনের কাজ বলছেন অভিভাবকরা।
স্কুলের বাথরুম এবং প্রাক-প্রাথমিক রুমের বেহাল দশার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি। যেখানে প্রাক-প্রাথমিক ক্লাস রুমটি থাকার কথা পরিপাটি ও বিভিন্ন খেলনা দিয়ে সাজানো। সেখানে চেয়ার টেবিল আর বেঞ্চ ছাড়া কিছুই ছিল না।
ওইদিন একজন ছাত্র ছাত্রীও স্কুলে নাই কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রধান শিক্ষক বলেন, পাশে হাই স্কুলে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে সবাই চলে গেছে। কিন্তু সঠিক বিষয়টি জানতে গিয়ে দেখা গেলো হাই স্কুলে প্রাইমারির কোন ছাত্র ওখানে নাই।
স্কুলটিতে মুসলিম শিক্ষক না থাকায় ছাত্র ছাত্রীদের ধর্মীয় শিক্ষা পড়ানো যাচ্ছে না। প্রধান শিক্ষক বলেন, এখানে ধর্মীয় শিক্ষক নাই ৭ বছর। আমরাই ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা পড়াই।
এছাড়াও স্কুলে একটি সরকারী ল্যাপটপ থাকার কথা থাকলেও, ল্যাপ্টবটি কোথায় এটার কোন উত্তর দেয়নি প্রধান শিক্ষক।
একই স্কুলের সহকারী শিক্ষক সুজন চাকমা অফিসের চেয়ারে বসেই, টেবিলের উপর দুই পা তুলে দিয়ে মোবাইলে গেমস খেলার নেশায় ব্যস্ত থাকার অভিযোগ করেছে অভিভাবকরা। যার প্রমাণ সহ তুলে ধরেন তারা।
স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোতালেব হোসেনের কাছে স্কুলের এই বেহাল দশার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্কুলে ভালো করে ক্লাস হয় না তাই ছাত্ররাও যায় না। এছাড়া অফিস কক্ষের বেহাল দশা এবং স্কুলের ল্যাপটপের বিষয়ে তিনি বলেন, ল্যাপটপ একটি স্কুলে সরকারীভাবে পেয়েছি। কিন্তু এখন সেটি কোথায় আছে প্রধান শিক্ষক জানে। আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা আমিও বেশ কয়েকবার তাদের বলেছি ছাত্রদের দিয়ে হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে।
স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সহ সভাপতি মনির হোসেন বলেন, আমরা চাই স্কুলটি পরিবর্তন করতে কিন্তু ছাত্র ছাত্রী ঠিক মত আসে না। আবার শিক্ষকরাও তেমন মনযোগী না। যার ফলে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রুস্তম আলী রুপ চান বলেন, স্কুলটির বেহাল দশা দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষকদের অবহেলার কারণে ছাত্র ছাত্রী স্কুলে আসে না। পুরো স্কুলে মুসলিম কোন শিক্ষক নাই, সবাই পাহাড়ী হওয়ায় বাচ্চারা স্কুলে আসতে চায় না। কারণ ছোট ছোট ছাত্ররা তাদের ভাষা সহজে বুঝতে পারেনা।এছাড়া হেলা অবহেলায় দিন যাচ্ছে স্কুলটির।
অভিভাবক ও ইয়ারিংছড়ি সেনামৈত্রী স্কুলের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, স্কুলটির শিক্ষকরা নিয়ম করে অনিয়মিত আসে। আজ দুজন আসলে, আগামীকাল অন্য দুজন আসে। তাছাড়া এখান থেকে পাশের হাই স্কুলে যখন ছাত্র গুলো যায়, এরা বাংলাটা পর্যন্ত বানান করে পড়তে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ধবংস হয়ে যাবে।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার এম কে ইমাম উদ্দীন বলেন, যেহেতু বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি, অবশ্যই খুব শীঘ্রই আমরা এর ব্যবস্থা নিবো। আশাকরি দু একদিনের মধ্যে স্কুলটির পরিবেশ পরিবর্তন হবে।
এবিষয়ে লংগদু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (অঃদাঃ) মো. মাসুদ রানা বলেন, বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।