কাপ্তাই উপজেলার ১ নং চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের বারঘোনিয়া রেশম বাগান তনচংগ্যা পাড়া চাইল্ল্যাতলি এলাকা।
সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯ টায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রওনা হলাম চাইল্ল্যাতলির তনচংগ্যা পাড়ার উদ্যোশে। কাপ্তাই – চট্টগ্রাম সড়কের রেশমবাগান পুলিশ চেকপোস্ট এর ডান পাশ ধরে প্রায় ৩ কিঃ মিঃ পাকা সড়ক ধরে অতঃপর এই পাড়ায় পৌঁছালাম। রাস্তার পাশে সুসজ্জিত ফুলের গাছ পেরিয়ে রুহিনী তনচংগ্যার ঘরে প্রবেশ করলাম। পাশে বসে আছেন তাঁর সহধর্মিণী গুনপতী তনচংগ্যা। যিনি তাঁর বুদ্ধ কীর্তনের গুণমুগ্ধ ভক্ত, সকল প্রেরণার উৎস।
এই চাইল্লা তলী পাড়ায় বসবাস করেন তনচংগ্যা ভাষার বুদ্ধ কীর্তন শিল্পী রুহিনী তনচংগ্যা। বয়স আশি । বিগত ৬০ বছর ধরে যিনি রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই, কাউখালি, বিলাইছড়ি ও রাজস্থলী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথাগত গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও ধর্ম দর্শন নিয়ে রচিত বুদ্ধ সন্ন্যাস কীর্তন পরিবেশন করে আসছেন। হারমোনিয়াম, করতাল আর মৃদঙ্গের অপূর্ব ঝংকারে আশি বছর বয়সেও যাঁর কন্ঠের দ্যুতনায় মুগ্ধ হন হাজারো শ্রোতা। তনচংগ্যা ভাষার পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষাও বুদ্ধ কীর্তন পরিবেশন করে হাজারো শ্রোতার হৃদয়ের মনিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন।
কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে প্রবীন শিল্পী রুহিনী তনচংগ্যার। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ সংগীত জীবনের কাহিনী একে একে শুনালেন এই প্রতিবেদককে।
রুহিনী তনচংগ্যা জানান, আমার জন্ম ১৯৪৩ সালে এই পাড়ায়। বয়স যখন আমার ৯ কি ১০ বছর তখন রাঙামাটি সদর উপজেলার বড়াদম মৌজার প্রয়াত বুদ্ধ কীর্তন শিল্পী হরেন্দ্র চাকমা এবং আমার বড় ভাই খগেন্দ্র তনচংগ্যার বুদ্ধ কীর্তন শুনে মুগ্ধ হতাম। তাঁরা বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে বিভিন্ন পোষাকে সজ্জিত হয়ে বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা গাইতো। সিদ্বার্থ গৃহত্যাগ কাহিনী গুলো তাঁরা সুরে সুরে, তালে তালে পরিবেশন করতো। আমি তাদের দলে দোয়ারি হিসাবে কাজ করতাম। তখন ” গানের স্তবক শেষ হলে ” বুদ্ধ বল, বুদ্ধ বল, ” লাইনগুলো সুরে তালে গাইতাম। তাদের সাথে গাইতে গাইতে আমি বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা রপ্ত করি।
প্রবীন এই বুদ্ধ কীর্তন শিল্পী আরোও জানান, বিগত ৬০ বছর ধরে আমি কাপ্তাই, রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, রাঙামাটি, কাউখালি সহ প্রত্যন্ত এলাকায় এক হাজারেরও উপরে বুদ্ধ সন্ন্যাস পালাটি গেয়েছি। রাত ১০ টায় শুরু করলে সেই সকালে গানের আসর ভাঙ্গতো। হাজার হাজার শ্রোতা রাতভর সেই গান উপভোগ করতো। তাঁর বড় ভাই আদি তনচংগ্যা( বর্তমান নাম মৈত্রি জ্যোতি ভান্তে) হারমোনিয়াম সহযোগিতা করতো। ১০ থেকে ১২ জনের দল রাতভর বুদ্ধ সন্ন্যাস কীর্তন গাইবার সময় সঙ্গত দিত। কেউ বাজিয়ে, কেউ দোয়ার হিসাবে সহযোগিতা করে এই পালা কীর্তনকে আরোও প্রানবন্ত করতো।
রুহিনী তনচংগ্যা জানান, তৎকালীন আমাদের সমাজের কেউ মারা গেলে সেই মৃতদেহটা সারা রাত পাহারা দেওয়া হতো। সেই রাতে আমরা প্রয়াতে মঙ্গলার্থে বুদ্ধ কীর্তন করতাম। এইছাড়া প্রয়াত ব্যক্তির উদ্যোশে সংঘদান অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উৎসব এবং কেউ নতুন ঘরে উঠলে রীতি অনুযায়ী বুদ্ধ কীর্তনের আসর হতো, কিন্ত বর্তমানে যুগের হাওয়ায় অনেক কিছু বদল হয়েছে। আগের মতো গান হয়না। তবে মাঝে মাঝে গান পরিবেশন করে থাকি। তিনি জানান, প্রথম আসরে আজ হতে ৬০ বছর বয়সে যেদিন প্রথম গান করি, সেই পাকিস্তান আমলে ১০ টাকা বখসিস পেয়েছি, তা আজীবন আমার মনে থাকবে।
বারঘোনিয়া তনচংগ্যা পাড়ার ৮৩ বছর বয়সী নীলা চন্দ্র তনচংগ্যা জানান, রুহিনী বুদ্ধ কীর্তন খুব ভালো করতে পারে, তাঁর কন্ঠস্বর খুবই মিষ্টি।
বারঘোনিয়া তনচংগ্যা পাড়ার কার্বারী নীহার রঞ্জন তালুকদার জানান, আমি সেই ছোট বেলা হতে উনার কন্ঠে বুদ্ধ কীর্তন শুনে আসছি।
এলাকার বাসিন্দা দয়ারাম তনচংগ্যা ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য আথুই তনচংগ্যা জানান, তিনি আমাদের সমাজের একজন প্রবীন বুদ্ধ কীর্তন শিল্পী। উনাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।