বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে সরকারী কর্মচারী নিয়োগে সকল সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা অনুপাতে বৈষম্যহীন নিয়োগ প্রদানের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ।
রবিবার (৮ অক্টোবর) সকালে জেলা সদরে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ম তলায় বান্দরবান জেলা কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মোহাম্মদ মজিবর রহমান। লিখিত বক্তব্যে কাজী মজিবর রহমান বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলার অসহায় পিছিয়ে পড়া নিরীহ, নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত মানুষের সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে নিবেদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম।
শত বছর ধরে শান্তি ও সম্প্রীতির মাধ্যমে এখানে ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, তঞ্চঙ্গা, মুরং, খুমী, লুসাই, খেয়াং, পাংখোয়া চাক এবং বাঙ্গালীদের বসবাস।
এ যেন সম্প্রীতির এক নিবিড় মেলবন্ধন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাঝে ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প ছড়িয়ে উপজাতি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার অপচেষ্টায় লিপ্ত একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল। অত্যন্ত দুঃখজনক এই যে, সব ধরনের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এখানে বসবাসরত ৫৪% বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী চাকুরী ও সুযোগ-সুবিধাদি পাচ্ছে না। এমনকি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারী ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও চাকুরী থেকে বঞ্চিত।
তিনি আরও বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের জন্য মেডিকেল, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর কোটার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতি বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩২৫ জন উপজাতি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে কোটাতেই।
নতুন করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে এর সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে এই একই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বাঙ্গালীদের জন্য কোটাতো দূরে থাক তেমন কোনো সুযোগ এখনো তৈরী করা হয়নি। পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী পাহাড়ী- বাঙ্গালীদের জন্য দুই ধরনের নীতি চলমান রয়েছে।
যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ২,২২৫ জন বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধুমাত্র ৬০৭ জন বাঙ্গালী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষা, চাকুরী, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপজাতি জনগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে ও উপজাতি কোটার চাকুরী সুবাদে অনেক দূর এগিয়ে রয়েছে। পাহাড়ি ম্রো, খুমী, বম, ত্রিপুরা, তঞ্চাঙ্গা, চাক, পাংখোয়া ইত্যাদি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বাঙ্গালীদের ন্যায় বৈষম্যের শিকার। অপরদিকে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত দুর্ভাগা বাঙ্গালীরা সমতার ভিত্তিতে পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেনা। যার প্রেক্ষিতে এখানকার বাঙ্গালীরা শিক্ষা, চাকুরী, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক ও নেতৃত্বের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। এই চরম দুঃখ-দুর্দশা ও বৈষম্য পার্বত্য বাঙ্গালীদের যেমনটা অস্তিত্বহীন করেছে তেমনই বিস্ময়করভাবে সংকটপূর্ণ করে মেরুদন্ডহীন করেছে।
বর্তমানে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পার্বত্য বাঙ্গালী ছেলেমেয়েরা বেকার অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ অংশের ১০ অনুচ্ছেদে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য চাকুরী ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। অথচ বাঙ্গালীদের জন্য এরকম কোনো সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব বাঙ্গালী বসবাস করে তাদের শতকরা ৯৫% রয়েছে দারিদ্রসীমার নীচে। বর্তমানে উপজাতিদের স্বাক্ষরতার হার ৮৭% আর বাঙ্গালীদের স্বাক্ষরতার হার ৪৭% উপজাতীদের একচেটিয়াভাবে চাকুরী ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। উপজাতীয় এলাকাগুলোতে একের পর এক গড়ে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই সাথে উপজাতি সম্প্রদায়ের ছাত্র- ছাত্রীদের জন্য বহু ছাত্রাবাস ও আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাঙ্গালী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কোন ছাত্রাবাস নেই।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যার হার ১% এর কম হলেও চাকুরীর ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের জন্য ৫% আসন সংরক্ষিত। কিন্তু বাঙ্গালীদের জন্য এই সুবিধা নেই। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগামে হাজার হাজার উপজাতীয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি, সেনা অফিসার, প্রশাসনে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষক, ব্যাংকার, পুলিশ কর্মকর্তা, এনজিও কর্মকর্তা, বিদেশী সংস্থার কর্মকর্তা রয়েছে। বিপরীতে বাঙ্গালীদের সংখ্যা হাজার তো দূরের কথা শতের কোটাও পার হতে পারেনি।
সম্প্রতি নিয়োগের বৈষম্য নিয়ে তিনি বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ন্যস্ত বিভাগ সমূহে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেনীর নিয়োগে অবিলম্বে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি প্রতিহংসা, সাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমূলক নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করে পাহাড়ি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে জনসংখ্যা ভিত্তিক সমবণ্টন করে সরকারী কর্মচারী নিয়োগের জোর দাবী জানায়। দাবিগুলি না মানা হলে পরবর্তীতে আরো কঠোর আন্দোলন করবেন বলে জানান সংবাদ সম্মেলনে এই নেতা। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন, জেলা নাগরিক পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, দপ্তর সম্পাদক শাহজালাল সহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিক অনেকে।