কাপ্তাই এর ওয়াগ্গা ইউনিয়নের পাহাড়ি অধ্যুযিত একটি গ্রাম সাফছড়ি।এখানকার অধিকাংশ জনগোষ্ঠী তনচংগ্যা সম্প্রদায়ের।রাস্তার পাশে গুটি কয়েক দোকান, পাশে ওয়াগ্গা উচ্চবিদ্যালয়।সবকটি দোকান পাহাড়ী সম্প্রদায়ের মালিক হলেও মাঝখানে একটি দোকানের ক্যাশ বাক্সে বসে আছেন একটি মধ্যবয়সী নারী।কখনও টাকা নিচ্ছেন কখনও ক্রেতার নিকট নিজেই দোকানের পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করছেন।দেখা গেল দোকানে তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন বিক্রেতা নেই। গত শুক্রবার দুপুর ১২ টায় এক প্রতিবেদক গেলো তাঁর দোকানে , তিনি শুনালেন তাঁর জীবনের করুন কাহিনী, কিভাবে দুঃখকে জয় করে এগিয়ে যেতে হয়, সফলতার দাঁড় প্রান্তে যেতে হয়।
রত্না সেনের ,পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী গ্রামে।১৯৯১ সালে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয় রাউজানের দেওয়ানপুর গ্রামের দয়াল সেনের সাথে।এরপর তারা চলে আসেন কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া বাজারে।সেখানে তার স্বামী দয়াল সেন বেশ বড়সড় একটি মুদি দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।সুখেই চলছিল তাদের পারিবারিক জীবন।কথাই বলে না সুখ বেশীদিন কপালে সয় না।হঠাৎ কোন এক অচেনা ঝড় এসে ভেঙ্গে গেল তাদের স্বপ্ন। ঘাঘড়া বাজার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে গেল দয়াল সেন সহ আরোও অনেক ব্যাবসায়ীর দোকানপাট। জীবনের সম্ভল যা ছিল সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল সেন পরিবার।প্রবাদ বাক্য :মরার উপর খাড়ার ঘাঁ;কথাটি যেন রত্না সেনের পরিবারের জন্য যথার্থ ছিল।২০১২ সালে সকলকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে হ্রদরোগে আক্রান্ত হয়ে রত্না সেনের স্বামী দয়াল সেন চলে যান না ফেরার দেশে।রেখে যান প্রিয়তমা স্ত্রী রত্না সেন, কোলের পুত্র শিশু জয় সেন এবং কণ্যা পুজা সেন,জয়া সেন,এবং প্রিয়া সেনকে।সেসময় বড় মেয়ে পুজা সেন পড়তো নবম শ্রেণীতে,জয়া সেন সপ্তম শ্রেণী এবং ছোটমেয়ে প্রিয়া সেন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তো।
স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েননি রত্না সেন।শোককে শক্তিতে পরিণত করে শুরু করলেন নতুন উদ্যমে পরবর্তী জীবন।ছোট্ট পরিসরে শুরু করেন কাপ্তাই এর ওয়াগ্গা ইউনিয়নের সাফছড়িতে মুদি দোকান।ছেলে মেয়েদের ভর্তি করান স্থানীয় ওয়াগ্গা উচ্চবিদ্যালয়ে। শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন যুদ্ধ।
এরই মধ্যে তাঁর বড় মেয়ে পূজা সেন চট্টগ্রাম নার্সিং ইনস্টিটিউট হতে নার্সিং কোর্স সম্পন্ন করে বর্তমানে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসাবে কর্মরত আছেন। মেজ মেয়ে জয়া সেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা(IOM) কক্সবাজারে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট মেয়ে প্রিয়া সেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। রত্না সেনের ছোট ছেলে জয় সেন বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল ও কলেজ,কাপ্তাই এ একাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত আছেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে রত্না সেন জানান, চার ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করা তার জন্য দুরুহ ব্যাপার।মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজন থেকে কিছু সাহায্য সহোযোগিতা পাওয়া গেলে ও তা ছিল অপ্রতুল। এই একটি মাত্র দোকান থেকে তিনি সংসার থেকে লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করছেন।ছেলেমেয়েদের স্বাদের সবকিছু পুরন করতে না পারলেও তিনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে যতটুকু সম্ভব ব্যয় করার চেষ্টা করেছেন। মেয়েদের নাচ গান শিখিয়েছেন।খুব ভোর হতে রাত অবধি এই মুদি দোকানে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে স্বামী বিহীন এই সংসারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এক মুহুর্তের জন্য তিনি মনোবল হারাননি।কারন তার ছেলে মেয়েদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকতে চান, সুখ খুঁজে পেতে চান।
স্হানীয় ওয়াগ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুবিমল তংচংগ্যা জানান বিগত ২০ বছর ধরে এই মহিলা এই এলাকায় সততার সাথে মুদি ব্যবসা করে আসতেছেন।।স্বামী ছাড়া এই মহিলা তার ৪ সন্তানকে উপযুক্তভাবে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
সাফছড়ির বাসিন্দা বেতার ও টিভি শিল্পি জ্যাকলিন তনচংগ্যা জানান, রত্না বৌদি খুবই কর্মঠ, সারাদিন তিনি হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, তিনি ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চায় নিয়োজিত রেখেছেন।
ওয়াগ্গার চেয়ারম্যান চিরন্জীত তনচংগ্যা জানান, তনচংগ্যা অধ্যুষিত এই সাফছড়ি এলাকায় তিনি সকলের সাথে মিলেমিশে সততার সাথে ব্যবসা করছেন এবং ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, তা অনুসরণীয়।
রত্না সেন আরোও জানান, তিনি ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়ে যাবেন। তাঁর বড় মেয়ে পুজা সেন জানান, তার মা হচ্ছেন তাদের আর্দশ। মা কখনোও বাবার অভাব বুজতে দেয় নাই। এই জনমে এই রকম মা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
নেপোলিয়ন এর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করছি আজকের কাহিনী। একজন শিক্ষিত মা’ই পারে একটি আর্দশ জাতি গড়তে।। যেমনটি রত্না সেন’ রা করছে প্রতি মূহুর্তে।