লেখক ও মানবাধিকারকর্মী লেলুং খুমী বলেন খুমি ভাষার যে সংকটের কথা তুলে ধরা হয়েছে (পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষায় বিপন্নতার দিক দিয়ে প্রথমে লুসাই ভাষা, দ্বিতীয় হলো খুমী ভাষা) তা বাস্তব। তাদের জীবনধারা প্রান্তিক পর্যায়ে তো আছেই। সেই সাথে যেসব ভাষাগুলো (লুসাই, খুমী) বিপন্নতার মুখে রয়েছ সেগুলোর সংরক্ষন করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাা ইনস্টিটিউটের সম্পৃক্তকরণ সময়ের দাবীদার। শুধু তাই না সরকারী বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা জোরদার করা জরুরী মনে করেন।
জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন যে, আজকে পলিসি মেকার থাকলে খুব ভালো হত বিশেষ করে যারা মাতৃভাষায় প্রাথমিক ভাষার শিক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করেন। তিনি আরো বলেন আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা অনুবাদকরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন “আমার সোনার বাংলা.. আমি তোমায় ভালোবাসি” জাতীয় সঙ্গীতের অর্থ যখন মাতৃভাষায় অনুবাদ করে গায়, তখন সেটা শুধু সুর নয়, বরং অনুভব করতে পারবে। নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের মাত্রা ক্রমশ কমে যাচ্ছে যা আমাদের ভাষাকে হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কমিটির দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী বিষয়ক সুন্দর সুন্দর ধারা থাকলেও শিক্ষক পদায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে যেমন চাকমা স্কুলে মারমা শিক্ষক নিয়োগ, ত্রিপুরা অধ্যুষিত এলাকায় চাকমা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আরো মনোযোগী দেয়ার আহবান জানান। আদিবাসী সাহিত্য নিয়ে কাজ করার জন্য বাংলা একাডেমীতে সুযোগ সৃষ্টির জন্য দাবী জানান।
আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ৫টি ভাষা ছাড়াও আরো অনেক ভাষায় চালু করার উদ্যোগ গ্রহন করার আশ্বাস দিয়েছেন এমএলই ফোরামের তপন কুমার দাশ। সেই সাথে বাংলা একাডেমীতে আদিবাসী বিষয়ক ডে· রাখার আহবান জানান।
সৌরভ সিকদার বলেন গুণগত মানের শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষন ব্যবস্থা করতে পারলে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ৮০% সমস্যা সমাধান হবে। সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা পরিষদের শুধু আন্তরিকতা ও সহযোগিতা দরকার। মিডিয়া, বেতার কেন্দ্র, টিভি নিয়মিত আদিবাসী ভাষায় প্রোগ্রাম করার আরো উদ্যোগ নিতে হবে। কমিউনিটির ভিত্তিক পাড়ায় পাড়ায়, মন্দিরকেন্দ্রীক মাতৃভাষায় সেন্টার ব্যবস্থা জোরদারকরন, দৈনন্দিন চর্চায় আর যে সময়ে মত প্রচার করা সেসময়ে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন এই প্রতিষ্ঠান নানা আমলাতান্ত্রিকতায় জর্জরিত। যার কারণে ভাষা নিয়ে গবেষনার কাজ এক্ষেত্রে বিঘ্নিত হচ্ছে। সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করার আহবান জানিয়ে বলেন বাংলা ভাষার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রিকে ।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন ২০১৪ সালের পর আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনও হয়নি। বিপন্নতার দিক দিয়ে বিবেচনা করে খুমি, লুসাই, সাঁওতালী ভাষাসহ এবিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের আহবান জানান। সাংস্কৃতিক একাডেমী গড়ে উঠেছে কিন্তু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কাযকর ভুমিকা রাখার ক্ষেত্রে কাযকরি উপদেষ্টা কমিটি করা দরকার মনিটরিং করার ক্ষেত্রে। কমিউনিটি বেতারকেন্দ্র এর সুযোগদানসহ জাতীয়ভাবে অমর একুশে আদিবাসী কবিতা পাঠের আয়োজন করার জোর দাবী জানান।
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন তিনি এমএলই ফোরামের সাথে ২০১৮ সাল থেকে যুক্ত কিন্তু করোনার কারনে কিছুটা স্থবির হয়েছে। সাঁওতালী ভাষার সংকট হলো ভাষার বাহন বর্ণমালা নির্ধারণ তাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়ন সংকটের ক্ষেত্রে শিক্ষা উপকরন ও সহায়িকা সরবরাহের সংকট আছে বলে জানান। সেজন্য এনসিটিবিকে কমিউনিটি থেকেই তাগিদ দিলে এই সংকট রোধ করা যাবে। তিনি নীতি নির্ধারকের সাথে লবি এ্যাভোকেসী বৃদ্ধি করার আহবান জানান। আদিবাসী ভাষায় প্রকাশিত বই এনসিটিবিতে রাখার উদ্যোগ গ্রহন করবেন বলে কথা দিয়েছেন।
সুইজারল্যান্ড এ্যাম্বেসীর ইরস রব্বাইনী বলেন ভাষার বৈচিত্র্যতা মানুষের জন্য গর্ব ও আনন্দের সর্বজনীন উৎস। ভাষা মানুষের পরিচয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক এবং মানুষের সমতা ও অধিকারের সূচক।
প্রধান অতিথি কথা সাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমীর সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহনের অধিকার প্রতিটি শিশুর রয়েছে। সেই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা উচিৎ না। এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সাথে বাংলা একাডেমীতে পরিচালকের সাথে আলোচনা করে আদিবাসীদের সাহিত্য চর্চার জন্য আলাদা সেল খোলার ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছেন।
আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন মাতৃভাষায় শিক্ষক সংকট সব জায়গায়। সরকারী পরিকল্পনায় আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কোন বিকল্প নেই। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বলেন সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা আরেকটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে ঐ জাতিগোষ্ঠির সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া।