একটি লেখায় বলেছি, দাদুর সময়ে গ্রামে একজন ভিক্ষু পালনের ক্ষমতা দেখাননি। যদিও সে সময়ে গ্রামে ফলমূলের গাছ থেকে শুরু করে, খাদ্য শস্যের কোন অভাব ছিল না। লোকজনও ছিল কম। শুধু প্রয়োজন সময়ে ভিক্ষু ‘ফাং’ করে আনতেন। ভিক্ষুগণ সকালে এসে সন্ধ্যার আগে আগে চলে যেতেন। এলাকার প্রায় সকল ভিক্ষুর সাথে ছিল আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। সবাই সবাইকে চিনতাম। দেখা হলে খোঁজ-খবর নিতেন, মজাও করতেন।
বাবার সময়ে এসে একজন ভিক্ষু পালনের চেষ্টা চলে। এখন ১জন ভিক্ষুসহ ৭-৮জন শ্রমণের দল নিয়েই আমাদের ছোট পাড়া বা গ্রাম। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম দিকে ৫-১০জন ভিক্ষু নিয়ে কঠিন চীবর দান হলেও এখন ৫০-১০০+ জন ভিক্ষুর সমাগম ঘটে। পাড়ায় সম্পদ বেড়েছে তা কিন্তু নয়। আগে কেউ মদ উৎপাদন করতো না। গ্রামের সম্পদ কমেছে কি বেড়েছে তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ছেলেবেলায় আমাদের গ্রাম থেকে প্রতি সপ্তাহে কলাসহ অন্যান্য ফলমূলের বিক্রির ধুম পড়তো, এখন বাজার থেকে কলা না কিনলে শিশুরা খেতে পায় না। দুই একটি কলা গাছও আর দেখা যায় না। গ্রামের জন্য একটি শশ্মান ছিল। এখন আমাদের ছোট পারিবারিক শশ্মানকে সবার ঠিকানা বানিয়েছে। দাদু কষ্ট-বিষ্ট করে দুই ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছিলেন। ছোট ছেলে প্রকৌশলী হয়ে কিছু সম্পদ বানিয়েছিল তাও সবই গ্রামের বাইরে। নিজের ভাগে পাওয়া সম্পদগুলোকে তার মৃত্যুর পর পরই রেখে যাওয়া আত্নীয়রা বিক্রির আয়োজন করে দিয়েছেন। সব কিছু দেখে দাদুকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ‘তুমি নেংটি পরে হালচাষ করে, গোয়ালের গরু, বাগানের গাছ, বাঁশ বিক্রি করে ছেলেকে প্রকৌশলী করেছো কি তোমার দ্বারা সৃষ্ট সম্পদগুলোকে বিক্রি করে খাওয়ার জন্য? দাদু আর নেই, তাঁর ছোট ছেলে [ মারমাদের মধ্যে প্রথম দিকের একজন কর্মকর্তা] ও নেই, সুতরাং প্রশ্নের উত্তর মিলবে না।
সম্প্রতি মহালছড়িতে যতদিন অবস্থান করেছি, আমরা বন্ধুরা মিলে প্রতিদিন ২৪ মাইল এলাকায় আড্ডা দিতে গিয়েছি। আমরা প্রতিদিন খেয়াল করেছি, তীব্র শীতের দিনেও সন্ধ্যা নামার আগে থেকে শুরু হয় মারমাদের তীর্থ ভ্রমণের সারি সারি গাড়ির ছুটা ছুটি। তীর্থ ভ্রমণ বলে বুঝতে পারি গাড়িতে থাকা দুই-একজন ভিক্ষু আর বুদ্ধ পতাকা দেখে। আড্ডা দলের এক সিনিয়র সদস্য বিদ্যুৎ দা, জিজ্ঞেস করেন, ‘মারমারা জায়গা জমি বিক্রি করে ধর্ম কর্ম করছে। জমি-জমা শেষ হলে কি দিয়ে ধর্ম করবে?’ আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার উত্তর কি হতো? সময় থাকলে জানাবেন।
দাদু তাঁর সময়ে একজন ভিক্ষু পালনের সাহস করেননি। বাবার আমলে অনিয়মিত একজন ভিক্ষু লালন-পালন করেছেন। আমাদের সময়ে ছোট পাড়ায় ১জন ভিক্ষু সহ ৭-৮জন শ্রমণ রয়েছে। বৌদ্ধ বিহারকে ঘিরে ব্যয় বেড়েই চলেছে। দাদুরা বিহারে গেলে তেলে ভেজা সুতা নিয়ে প্রদীপ জ্বালাতেন। বাজার থেকে মোমবাতি কিনলেও ২টাকা দামের ছোট মোমবাতি প্যাকেটটি খুলে প্রতি বিহার দর্শনে দুই-তিনটির বেশি জ্বালাতেন না। শুধু ‘আমাংথং জাদি’/‘থামাং তথং জাদি’র দিনে গ্রামবাসীরা মিলে বাশেঁর কাঠিতে সুতায় তেল ভিজিয়ে শতাধিক প্রদীপ জ্বালাতেন। এখন কয়েক দশকের ব্যবধানে আমরা শতাধিক প্রদীপ ছাড়িয়ে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালাতে শিখেছি। গ্রাম থেকে আগে ১টি কি ২টি ফানুস উড়ানো হতো। এখন ১ ডজনও নয় শতাধিক ফানুস না উড়ালে তৃপ্তি পাই না। গ্রামের মান থাকে না।
একইভাবে এক সময় ভিক্ষুদের জন্য পিন্ড যে যার খুশি মতো বিহারে গিয়ে দান করতাম। অনুষ্ঠান হলে পিন্ডদান কিছুটা বাড়তো। এখন পাড়ায় রুটিন করে পিন্ডদানের চাপ কমানোর একটি ভাল উদ্যোগ থাকলেও আমাদের কিছু পয়সাওয়ালারা পিন্ডদানকেও সংখ্যায় হাজার করতে শিখেছেন। এক পয়সাওয়ালার হাজার পিন্ডদান শেষ হতে না হতে দেখাদেখি মারমারাও পিন্ডদানকে হাজারে নিয়ে প্রথাতে রূপান্তর করতে চেষ্টা চলছে।
পাহাড়ে আমরা কটা মানুষ মাত্র। তার মধ্যে হাজার বিহার, হাজারে হাজারে পিন্ডদান আয়োজন করে গরীব মানুষগুলোকে কিছু পয়সাওয়ালারা ধর্মীয় লোভে আটকে ফেলছেন কিনা আমাকে ভাবায়। মারমারা যা দেখে সেগুলোকে আক্ষরিকভাবে শেখে, গ্রহণ করে, চর্চা করে। পাহাড়ে শিক্ষিত পয়সাওয়ালারা সর্তক না হলে এই মারমাদের অস্তিত্ব, পশু-পাখিদের ন্যায় বিপন্ন তালিকায় উঠবে। সেই থেকে পয়সাওয়ালাদের আহবান করতে চাই, পয়সা থাকলেই হবে না দূরদর্শীসম্পন্নও হওয়া চাই। পাহাড়ে যত চাষযোগ্য জমি আছে প্রায় সবই মারমাদের। এই মারমারা জায়গা জমি বিক্রি করে স্থানান্তরিত হতে থাকলে আমাদের সকলকেও ভোগাবে।
সমাজের বিশাল এক শ্রেণি এখন ধর্মীয় লোভে দারুণভাবে আক্রান্ত। এটি একটি অসুখও। এক মৃত ভিক্ষুকে শীঘ্রই ফিরে আসছেন বলে, প্রতিদিন গাড়ি ভাড়া করে দর্শনে যান। হাজার হাজার বছর আগে মিশরীয়রা মমি করা শিখলেও খবরটি মারমা শিক্ষিতদের মাঝে এখনো পৌঁছেনি। একটি অংশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তাদের শিক্ষিত গুরুভান্তে ফিরবেন। অচিরেই জীবন লাভ করবেন। বিশ্বাস না করলে খাগড়াছড়িতে এসে ঘুরে দেখে যান, কি পরিমাণে মারমারা সেই বিশ্বাসকে সামনে রেখে পয়সা খরচ করছে, দর্শনে গিয়ে ঐ এলাকার মানুষগুলোকে পয়সাওয়ালা বানাচ্ছে।
শিক্ষিত, পয়সাওয়ালাসহ ধর্মীয় লোভীদের পয়সা খরচ করার আগে একবার ভাবা উচিত। হাজার ভিক্ষুকে পিন্ডদান করলেই অধিক পূণ্য লাভ হবে আমি বিশ্বাস করি না। মারমা ভাষায় একটি ধর্মীয় প্রবাদ আছে “লুফো মতাইকে, ঞংবালক হ্লুব ঞংচিলক মরানুইং। লুফো তাইকে, ঞংচিলক হ্লুবলে ঞংবাংলক রানুইংরে।” অথাৎ এর আক্ষরিক বাংলা করলে হয় “দান করতে না জানলে বটগাছের সমান দান দিয়ে বটফলের সমান পুণ্য মিলে না। তবে দান করতে জানলে বটফলের সমান দান দিয়েও বটগাছের সমান পূণ্য মিলতে পারে”। পূণ্য লাভের আগে, স্বর্গ দর্শন লাভের লাগে, এই ‘নরক পৃথিবীতে’ যতদিন থাকবো একত্রে মিলেমিশে শান্তিতে থাকার প্রচেষ্টা থাকা চাই। নরক যন্ত্রনা নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করার মাধ্যমে স্বর্গের প্রাপ্তি ঘটবে বিশ্বাস করতে পারি না।
আমরা থাকলেই বিহার থাকবে। বিহারকে দিনকে দিন বয়বহুল করে চলেছি, গাড়ি দিচ্ছি। এক বিহারের দেখাদেখি আরেক বিহার চাইবে। আমরা কি আদৌ বিহারকে বিলাসবহুল গাড়ি দিয়ে লালন পালন করার ক্ষমতা রাখি?
আগে অনেক কষ্টে সকলে মিলে ১টি বুদ্ধমূর্তি দান করতে দেখেছি। এখন কথায় কথায়, সময়ে-অসময়ে বুদ্ধমূর্তি দানও একটি ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। এত এত বুদ্ধমূর্তি দিয়ে কি করবো? কোটি কোটি টাকার বুদ্ধমূর্তি বানিয়ে কি হবে, যদি সেই বুদ্ধমূর্তিটি নিমার্ণ শৈলীতে আধুনিকতা আর বিজ্ঞানের সংমিশ্রন না থাকে, অচিরেই পতিত হবে। আমাদের শ্রম, অর্থ ব্যয়কে ধরে রাখতে কাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগ থাকা আবশ্যক।
বাজারে গেলে গ্রামীন গরীব পাহাড়ি নারীদের ৫-১০টাকার শাক বিক্রির আশায় সন্ধ্যা অবধি বসে থাকার দৃশ্য আমাকে মর্মাহত করে। আমাদের অর্থ ব্যয় হওয়া উচিত দারিদ্রতা, অন্ধকার, কুসংস্কার দূর করে সকলের মাঝে আলো দান করার। আমার বিশ্বাস আলো দানই শ্রেষ্ঠ দান হবে। আপনিও বেঁচে থাকবেন। বুদ্ধ অন্ধকার দূর করে আলো দান করতে গৃহ ত্যাগ করেছিলেন বলে বিশ্বাস করি। তাই তিনি আজো বেঁচে আছেন। পৃথিবীতে তাঁকে নিয়ে আজও গবেষণা চলছেই। এটাইতো স্বর্গ।
সাংবাদিক হোসেন সোহেলের সাম্প্রতিক ৮ জানুয়ারি তারিখের ভিডিও প্রতিবেদনটি দেখুন, পাহাড়ে কত শত পরিবার স্কুল ছাড়া রয়েছে। পয়সা খরচ করে হাজার হাজার ভিক্ষুকে পিন্ডদান করলে হবে না। আলো ছড়ানোর উদ্যোগ থাকা চাই। গৌতম বুদ্ধ যিনি নিজেই জ্ঞান লাভের চেষ্টা করে দুঃখ মুক্তির উপায় আবিস্কারের পরে বসে থাকেন নি। তিনি তার সাধ্যমত জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর পিতার জায়গা জমি বিক্রি করে জ্ঞান দান করতে যাননি। নিজের আবিস্কৃত জ্ঞান দানের চেষ্টা করে পৃথিবীতে আলো জ্বালাতে চেয়েছিলেন। আমরা সে আলোর খুঁজে চলেছি মাত্র। তাঁর আলো পেতে যেখানে সেখানে দান না করে সঠিক, সুন্দর, টেকসই, গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় হওয়া চাই। একই সাথে দানের সংখ্যা হাজারে না গিয়ে আমার দাদুদের সময়ে ধর্ম চর্চায় ফিরে যাওয়া আবশ্যক বলে মনে করি। যেখানে ছিল না প্রচারনা। তারা মন থেকে নিজের সাধ্যমত দান করে, ধর্ম চর্চা করেছেন। ধর্মীয় বই পড়তে দূর দেশ থেকে আনিয়েছে। অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। ধর্মের নামে গ্রামের কাউকে শ্রম ছাড়া হাজার হাজার অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। সে সময়ে আমরা ছিলাম পশু-পাখি, ফলমূল আর শস্যে ভরা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামে। হাজার টাকা দান, হাজার প্রদীপ দান, হাজার ফানুস, বিলাসবহুল গাড়ির বদলে দাদুর দেখানো সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামে ফিরতে চাই। দাদুদের ন্যায় ধর্ম চর্চা করতে চাই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক। ইমেইল: nyohlamong2@gmail.com