খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের আগুন ছড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এবং পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে পানছড়ি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটি।
আজ শনিবার (২৫ মার্চ ২০২৩) সকাল ১১টার সময় পানছড়ি উপজেলার মনিপুর হতে পুজগাঙ এলাকা পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে এলাকর সর্বস্তরের জনসাধারণ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বিরোধী বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
“বৈ সা বি উৎসবের প্রাক্কালে পানছড়িতে জেএসএস-এর সশস্ত্র গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ও হুমকিমূলক অবস্থান কেন? সন্তু-হাসিনা জবাব চাই” শ্লোগানে আয়োজিত মানববন্ধনে পানছড়ি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও পানছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা’র সভাপতিত্বে ও চেঙ্গী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অনিল চন্দ্র চাকমা’র সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন চেঙ্গী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কালাচাঁদ চাকমা। এতে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন খাগড়াছড়ি জেলা কার্বারী এসেসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হেম রঞ্জন চাকমা, লতিবান ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কিরন ত্রিপুরা, চেঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা, পানছড়ি সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অসেতু বিকাশ চাকমা, উল্টাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সুব্রত চাকমা প্রমুখ।
কালাচাঁদ চাকমা বলেন, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যুগ যুগ ধরে নিপিড়ীত-নির্যাতিত হয়ে আসছি। এই অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য আমাদের মধ্যে সংগঠন গড়ে উঠেছে। আমরা আশা করেছিলাম এসব সংগঠনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জনগণ মুক্তি পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজকে আমাদের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য মানববন্ধন করতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র নেতাকর্মীরা যেভাবে কষ্ট করছেন তার সুফল তখনই আমরা পাবো যখন ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যাবে। ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা পার্বত্য চুক্তিও বাস্তবায়ন করতে পারবো, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনও অর্জন করতে পারবো। তাই উভয় দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাবো অচিরেই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ হোন।
কার্বারী হেম রঞ্জন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন হয়েছে। তাই আমরা আর ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত চাই না। যারা নতুন করে পানছড়িতে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বাঁধানোর পাঁয়তারা করছে তাদেরকে বলতে চাই, আমরা আর সংঘাত চাই না, আমরা শান্তিতে থাকতে চাই, শান্তিতে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে চাই। পানছড়ি উপজেলায় যাতে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত সৃষ্টি করা না হয় সেজন্য পানছড়ি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আমি জোর দাবি জানাচ্ছি।
সুব্রত চাকমা বলেন, আমরা সকলেই জানি ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করলে ক্ষতি বাদে লাভ হবে না। তাই আজকের এই মানবববন্ধন থেকে আমি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই।
আনন্দ জয় চাকমা বলেন, আমরা দেখছি এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত আমাদের মনে কী পরিমাণ ভয় সৃষ্টি করছে। যদি ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি মারামারি না থাকতো তাহলেপাহাড়ের মানুষ অনেক ভালো থাকতো। সমাজের জন্য ভালো অনেক কিছু করতে পারতো। কিন্তু আমরা তো ভালো নেই, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভালো নেই। সেজন্য আমরা সর্বস্তরের জনগণ একত্রিত হয়ে মানববন্ধন করে অচিরেই ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি বন্ধের দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জাতিকে যে পিছনে নিয়ে যাচ্ছে তা যদি ২০২৩ সালে এসেও আমরা না বুঝি তাহলে আমরা আরো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমরা জানি আর ১২/১৫ দিন পরেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিঝু-বৈসু-সাংগ্রাই উৎসব শুরু হবে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এ উৎসব পালন করতে চাই। কিন্তু চলমার সংঘাতমূলক পরিস্থিতির কারণে আমরা সবাই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।
তিনি বিগত সময়ের সকল হানাহানি, মারামারি ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন করে জাতি গঠনের কাজ শুরুর আহ্বান জানান।
কিরন ত্রিপুরা বলেন, দীর্ঘ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের কারণে আমরা অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা আর সংঘাত চাই না। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। আগামী বৈ সা বি উৎসব যাতে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা যায় সেজন্য পানছড়ির সর্বসাধারণের পক্ষ থেকে অবিলম্বে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য জেএসএস ও ইউপিডিএফ নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
অসেতু বিকাশ চাকমা বলেন, কিছুদিন আগে আমরা বিক্ষোভ মিছিল করেছি। সেই মিছিল থেকে আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি-হানাহানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছি। তিনি বলেন, একটি মহল আমাদের পানছড়ি এলাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার পাঁয়তারা করছে। আমরা জুম্ম জনগণের নেতৃত্বদানকারী দল ইউপিডিএফ ও জেএসএস’র প্রতি আহ্বান জানাই, আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ, আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিন। অন্তত পানছড়ি এলাকায় মারামারি-হানাহানি বন্ধ করুন।
ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা বলেন, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, শোষিত-বঞ্চিত। এরপরও এখনো আমাদের হুঁশ হয়নি। জাত শেষ হলেই কি তবে হুঁশ ফিরবে?
তিনি বলেন, জেএসএস’র আদর্শ হচ্ছে চুক্তি বাস্তবায়ন আর ইউপিডিএফের আদর্শ হচ্ছে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। দুই দলের যদি কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়, কোন অসংগতি থাকে তাহলে কেন্দ্রীয়ভাবে আলোচনায় বসে এর সুষ্ঠু সমাধান করুন। এভাবে জনগণের জানমাল ও অধিকার ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। রাজপথে বিভিন্ন সভা সমাবেশের মাধ্যমে সংঘাত বন্ধের কথা বলছি। কিন্তু আমাদের দাবির কোন তোয়াক্কা না করে উল্টো আরো নতুন করে সংঘাত শুরুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জনগণের জন্য কাজ করলে জনগণের দাবি কেন মানা হচ্ছে না?
তিনি জেএসএস-ইউপিডিএফ’র মধ্যে ২০১৮ সালে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে সে মোতাবেক আলোচনার ভিত্তিতে যার যার এলাকায় সাংগঠনিক কাজ করার আহ্বান জানান।
বৈ সা বি উৎসবের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে তিনি জেএসএস নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা পানছড়ি এলাকার জনগণ শান্তিপ্রিয়। আমরা শান্তি চাই। আপনারা আমাদের উৎসব পালনের জন্য শান্তিপুর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে দিন। পানছড়িতে অন্তত সংঘাত বন্ধ করুন।
তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, নিজের জীবন, নিজের ঘর, জায়গা-জমি রক্ষার জন্য আমাদের অবশ্যই সত্য কথা বলতে হবে। যদিও সত্য কথা বলার কারণে প্রশাসন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়, হয়রানি করে থাকে। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান হলে কী হবে ৫ বছরে একবারও উপজেলা পরিষদে বসতে পারিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি তুলে ধরে শান্তি জীবন চাকমা বলেন, প্রতিদিন আমরা নানা ঘটনার কথা শুনে থাকি। প্রতিনিয়ত বহিরাগত বাঙালি অনুপ্রবেশ ও ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন, অন্যায় ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটছে। বান্দরবানে বিভিন্ন জুম্ম জাতিসত্তার লোকজনকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। সীমান্ত সড়কের নামে আমাদেরকে খাঁচার ভিতর বন্দি করা হচ্ছে।
তিনি অবিলম্বে সংঘাত বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা আর ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করে কোন মায়ের বুক খালি হতে দিতে পারি না।
বার্তা প্রেরক
কালাচাঁদ চাকমা
সদস্য
পানছড়ি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটি।