রাঙামাটির বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বামউক বা বিএফডিসি)’র দুর্বল ব্যবস্থাপনায় আশংকাজনকহারে কমতে শুরু করেছে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য উৎপাদন। অব্যবস্থাপনার নজরদারি না থাকায় ধংসের পথে হ্রদের মৎস্য সম্পদ।
বছর বছর মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি দেখালেও আয় বৃদ্ধি দেখাতে পারছে না বিএফডিসি। অভিযোগ আছে মৎস্য থেকে রাজস্ব আদায়ের পর হিসাব নয় ছয় করে সরকারকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বিএফডিসির কর্মকর্তারা।
বিএফডিসির তথ্যমতে ২০২০-২১ অর্থ বছরে হ্রদ থেকে মাছ আহরিত হয়েছে ১৩,৯১৫ টন। এ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অপরদিকে ২০২১-২২ অর্থ বছরে মাছ আহরিত হয়েছে ২০,১৯১ টন। এ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
বিএফডিসির এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের জরিপ মতে হ্রদে বাড়তি উৎপাদিত মাছগুলো স্থানীয়দের পেটে যাচ্ছে। এ থেকে রাজস্ব আদায় করে না বিএফডিসি। ফলে আমাদের মাছের উৎপাদন বাড়লেও আয় বাড়ছে না।
বিএফডিসির তথ্যমতে, কাপ্তাই হ্রদে মাছের অভয়াশ্রম ৭টি। অভয়াশ্রমের যেসব বৈশিষ্ট্যর থাকার কথা সেগুলোর মধ্যে হচ্ছে; অভয়াশ্রম দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে না। সারা বছর অভয়াশ্রমে পানি থাকবে। মা মাছগুলো অভয়াশ্রমে সংরক্ষিত থাকবে। সেখানে মাছ শিকার সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। অভয়াশ্রমে খাবার প্রদান। সার্বক্ষণিক এগুলো চোখে চোখে রাখা। কিন্তু এসব কোনটি মানা হয় না অভয়াশ্রমে।
বিএফডিসির তথ্যমতে অভয়াশ্রমগুলো হল ডিসি বাংলো এলাকা, বিএফডিসি অফিস সংলগ্ন এলাকা, মুন্সী আব্দুর রউফ মাজার এলাকা, রাজবন বিহার সংলগ্ন এলাকা, লংগদু কাত্তলী বিল সংলগ্ন এলাকা, বিলাইছড়ি রাইক্ষিয়ং নদীর চক্রছড়ি এলাকা ও কাপ্তাই নৌ/সেনা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা।
এর মধ্যে শুধুমাত্র ডিসি বাংলো ও কাপ্তাই নৌ/সেনা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকাটি অভয়াশ্রমটি কিছুটা অক্ষত থাকলেও নষ্ট হয়েছে বাকীগুলো।
স্বয়ং নিজেদের অফিস সংলগ্ন অভয়াশ্রমটি রক্ষা করতে পারেনি বিএফডিসি। অভয়াশ্রমে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ হলেও এ অভয়াশ্রমের উপর স্থাপন করা হয়েছে পর্যটক ও যাত্রীবাহী স্পীড বোট স্টেশন। ফলে এ অভয়াশ্রমের উপর দিয়ে সারাদিন চলে শত শত ইঞ্জিন চালিত নৌ যান। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্বয়ং বিএফডিসি অভয়াশ্রম এলাকায় নির্মাণ করেছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র।
এ ছাড়া রাজবন বিহার সংলগ্ন, মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন, চক্রছড়ি অভয়াশ্রমগুলো মাছের প্রজননের সময় থাকে ডাঙায়।
রাঙামাটি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বি. এম. শাহিনুর রহমান বলেন, আমাদের গবেষণার তথ্যমতে কাপ্তাই হ্রদের বড় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। শুধুমাত্র কেচকি চাপিলা মাছের উৎপাদন বেড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী অভয়াশ্রমে সারা বছর পানি থাকবে। সেখানে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের ক্ষেত্রে সব অভয়াশ্রমে নৌযান চলে।
বিএফডিসির তথ্যমতে অভয়াশ্রম দেখাশুনা করার জন্য প্রত্যকটি অভয়াশ্রমে দুজন করে রাজস্ব খাতের জনবল নিয়োগ আছে। অভিযোগ আছে এ জনবল অভয়াশ্রমের খবরই রাখে না। এরা পড়ে থাকে রাঙামাটির বিএফডিসি অফিসে। এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না বিএফডিসি।
এদিকে কাপ্তাই হ্রদের কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধংস হওয়ায় প্রতি বছর কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়ে বিএফডিসি। প্রজননের সুবিধার্থে প্রতিবছর মে মাস থেকে পরবর্তী তিনমাস মাছ শিকার বন্ধ থাকে হ্রদে। এ সময় হ্রদে মাছের পোনা ছেড়ে দেয়া হয়।
অভিযোগ আছে, প্রত্যক বছর মাছের পোনা সঠিক সময়ে ছাড়া হয় না। এ বছরও তাই হচ্ছে। মাছ শিকার বন্ধের ২ মাস অতিবাহিত হলেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পোনা ছাড়তে পারেনি বিএফডিসি। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আগ মুহুর্তে পোনা ছাড়া হলে সেগুলো জেলেদের জালে ধরা পড়ে।
এ ছাড়াও কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বিএফডিসি রাঙামাটি ব্যবস্থাপক। কাপ্তাই হ্রদে মাছ বিলুপ্তির অন্যতম কয়েকটি কারণের মধ্যে পানি দুষণ, নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার।
অভিযোগ আছে, হ্রদ দখল, হ্রদ ভরাট, হ্রদ দুষণ নিয়ে কোন কথাই বলেন না বিএফডিসিরি কমান্ডারগণ। এরা শুধু মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ঘাটের রাজস্ব আদায় নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দায় ছাড়েন বিএফডিসি কর্মকর্তারা। তিন মাসের জন্য যখন মাছ শিকার বন্ধ থাকে তখন বিএফডিসির কর্মকর্তারা অফিস ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করেন । এ সময় তাদের অফিসে পাওয়া যায় না।
বিএফডিসির একাধিক কর্মকর্তা জানায়, শিকার বন্ধ থাকায় বর্তমানে কমান্ডার মো: আশরাফুল আলম ভূঁইয়া কোথায় অবস্থান করছেন তা জানেন না। অনলাইনে অফিস করছে কমান্ডার।
রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. হারুনুর রশীদ বলেন, হ্রদে মৎস্য উৎপাদন দিন দিন তলানীর দিকে যাচ্ছে। এজন্য দায়ী বিএফডিসির অ ব্যবস্থাপনা।
মাছ শিকার বন্ধকালীন সময়ে অবৈধভাবে মা মাছ ও পোনা শিকার, পাচার, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করা হয়।
এসব বিষয়ে তথ্য দিতে গত ১ জুন সম্প্রতি আমরা ম্যানেজোরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ম্যানেজার আমাদের সাথে দেখা করেনি। দীর্ঘক্ষণ বাইরে দাড়িয়ে রাখার পর মার্কেটিং অফিসার রিয়াদ আমাদের জানিয়ে দেন কমান্ডারের সাথে দেখা করতে হলে আগে লিখিত আবেদন দিতে হবে। এ বিষয়টি আমরা বিএফডিসি চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে জেলা ব্যবস্থাপক কমান্ডার মো আশরাফুল আলম ভূইয়া বলেন, তিনি সাংবাদিকদের সাথে মৌখিক কোন কথা বলতে পারবেন না। নিয়ম নেই। কি জানতে চান তা তথ্য অধিকার আইনে লিখিতভাবে আবেদন করেন। এ আইনের বাইরে আমি মিডিয়ায় কোন কথা বলব না। উপরের নিষেধাজ্ঞা আছে।
প্রসঙ্গত ১৯৬০ সালে কর্নফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে ৭২৫ বর্গমাইল এলাকায় পানিতে তলিয়ে যায়। এ তলিয়ে যাওয়া অংশটি কাপ্তাই হ্রদ নামে পরিচিতি পায়। এ কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টির ফলে কাপ্তাই হ্রদ মাছের ভান্ডারে পরিণত হয়। এ মাছ ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেয় সরকার।