পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চুক্তি মোতাবেক পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীবিষয়ক অধিকার আন্দোলনের নেতারা। তারা বলছেন, চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজনৈতিক ও সামাজিক ইন্ধনে গড়ে উঠছে সশস্ত্র বাহিনী। যার বিপরীতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে নতুন আন্দোলনের সূচনা করতে যাচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শনিবার (৩ ডিসেম্বর ) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক আলোচনাসভায় তিনি এসব কথা বলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম যৌথভাবে এ আলোচনাসভার আয়োজন করে। এই দুই সংগঠনের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সভাপতিত্বে আলোচনায় যোগ দেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের কো-চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সমন্বয়কারী অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঐক্য ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম এ সবুর, বাসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য মোস্তফা আলমগীর রতন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানাসহ আরও অনেকে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ে আন্দোলন দানা বাঁধছে, এমন আভাস দিয়ে সন্তু লারমা বলেন, বছরের পর বছর পার্বত্য অঞ্চলের অধিকার, জুম্ম জাতির আন্দোলন-সংগ্রামকে নতুনভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পার্বত্য চুক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আদিবাসীরা হয়তো আপাতত ভাবতে পারছে না। কিন্তু মুক্ত সমাজে বেঁচে থাকার যে আকাঙ্ক্ষা তা থেকে কিন্তু পাহাড়িরা সরে যাবে না। অন্যায়-নিপীড়ন-নির্যাতন যেখানে চলতে থাকে, সেখানে আন্দোলন কখনো থেমে যায় না। পার্বত্যাঞ্চলে এখন নতুন ভাবনার উদয় হচ্ছে।
সুলতানা কামাল বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে গোয়েবলসীয় কায়দায়, বারবার মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি যখন ক্ষমতায়, তখন পাহাড়ি ক্ষুদ্র একটা জনগোষ্ঠীকে কেন সামরিক শাসনের অধীনে রেখে দেব? এটা তো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কথা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিজয়ের পর বলেছিলাম, আমরা আর সামরিক শাসনের অধীনে থাকব না। তাহলে সামরিক শাসনের নামে আমরা পার্বত্যবাসীকে ঠকাচ্ছি।’
পাহাড় বা সমতলে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকের রাষ্ট্রীয়ভাবে যে নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দেওয়া হয়েছে তার সমালোচনায় তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিচয়টি ভিত্তিহীন। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে উপহার দেওয়া হয়েছে। পাহাড়িরা আজকে নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে গেছেন।’
পাহাড়ে বা সমতলে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন নানাভাবে নস্যাৎ করে দেওয়া হয় বলে মন্তব্য করেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। তিনি বলেন, ‘আজকে আদিবাসীদের নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। বহু এজেন্সি রয়েছে এর পেছনে, নানাভাবে কেড়ে নেওয়া হয় আমাদের আন্দোলন, ধ্বংস করে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।’
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ২৬ বছর পূর্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে জনসংহতি সমিতির কাউকে যুক্ত না করার সমালোচনা করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। সরকারের ইন্ধনেই পাহাড়ে বিভিন্ন উগ্র-সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মেসবাহ কামাল বলেন, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটা উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে যে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে, কাদের উদ্যোগে বা কাদের প্ররোচনায় গড়ে উঠেছে? কুকি চীন নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। মৌলবাদী-উগ্রবাদীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ।’
সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘উন্নয়নের নামে আজকে পাহাড়ি জনপদে দখলদারিত্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে, শান্তির কথা বলে নতুন করে অশান্তি ডেকে আনা হচ্ছে।’
–দৈনিক খবরের কাগজ