ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মানবাধিকার পরিবীক্ষণ সেল ২০২৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
বুধবার দলটির প্রচার সম্পাদক নিরণ চাকমা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ করে দলটি।
এতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, ঠ্যাঙাড়ে, জেএসএস ও অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে বিচার বহির্ভুত হত্যার শিকার হয়েছেন ২৫ জন; গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন ৪৯ জন; শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১ জন; অপহৃত হয়েছেন ৪৩ জন; যৌন সহিসংতার শিকার হয়েছেন ২৩ জন নারী ও শিশু।
এছাড়া ১৪ জন গ্রামবাসীর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে, ১৩টি স্থানে ভূমি বেদখল অথবা বেদখলের চেষ্টা হয়েছে। পাহাড়িদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৭টি; ধর্মীয় পরিহানির ঘটনা ঘটেছে ৩টি; হয়রানির শিকার হয়েছেন ৫ জন।
গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৯টি; রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বেপরোয়া গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬টি, যাতে ৪ জন নারী-পুরুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং সেনাবাহিনীর কম্বিং অপারেশনের কারণে অন্তত ৮২টি পাহাড়ি পরিবারের লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
আজ ১০ জানুয়ারি ২০২৪ প্রকাশ করা রিপোর্টে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির বর্তমান বিশেষত্ব হচ্ছে নিপীড়িত-নির্যাতিত অধিকারহারা জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি নব্যমুখোশ বাহিনী, মগপার্টি, সংস্কারবাদীর মতো ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর ব্যবহার। এদের মাধ্যমে আন্দোলনের নেতা-কর্মী ও তাদের সমর্থকদের খুন, গুম, অপহরণ করে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। এই বাহিনীগুলো ছাড়াও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সন্তু গ্রুপও প্রায় সময় সাধারণ জনগণের মানবাধিকার লংঘন করে থাকে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০২৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের মধ্যে রয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যা, গ্রেফতার, শারীরিক নির্যাতন, তল্লাশি-হয়রানি, ধর্মীয় পরিহানি, নারী নির্যাতন ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, হামলা, ভূমি বেদখল ইত্যাদি।
প্রধানত ইউপিডিএফকে লক্ষ্যবস্তু করে নিরাপত্তা বাহিনী এসব নিবর্তনমূলক কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।
রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা তুলে ধরো বলা হয়, গত বছর নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ১ জন সাধারণ নাগরিক, গ্রেফতার করা হয়েছে ইউপিডিএফ সদস্যসহ অন্তত ৪৯ জনকে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯ জন, বেআইনি তল্লাশি চালানো হয়েছে ১৪ গ্রামবাসীর বাড়িতে, হেনস্থা-হয়রানির শিকার হয়েছেন নারীসহ ৫ জন, নিরাপত্তা বাহিনী ও বিজিবির গুলিতে আহত হন ২ জন, গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৮টি, ধর্মীয় পরিহানির ঘটনা ঘটেছে ৩টি। এছাড়া বিজিবি কর্তৃক নাইক্ষ্যংছড়িতে গ্রামবাসীদের ওপর হামলা, সাজেকে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের জমি দখল করে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে এবং বান্দরবানে “কুকি-চিন আর্মি দমনের” নামে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচালিত কম্বিং অপারেশনের কারণে বম জাতিগোষ্ঠির ৮২টি পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে উপজেলা সদরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
জেএসএস সন্তু গ্রুপের মানবাধিকার লংঘনের তথ্য তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, জেএসএস সন্তু গ্রুপও মানবাধিকার লংঘনের সাথে জড়িত। গত বছর তারা ইউপিডিএফ’র এক সদস্যকে হত্যা, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রীসহ ৫ জনকে অপহরণ, ৪ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও রাঙামাটিতে সমাবেশে বাধা প্রদান করে।
রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্যমুখোশ বাহিনী ও অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা ইউপিডিএফের ৫ নেতা-কর্মীসহ ২২ জনকে হত্যা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতা-কর্মীসহ ৩৮ জনকে অপহরণ করে এবং ৬ জনের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়।
এছাড়া তারা ৪টি ছিনতাই ঘটনার সাথে জড়িত ছিল এবং ইউপিডিএফ কর্মীদের ওপর একটি হামলাসহ (হতাহত হয়নি) কয়েকটি স্থানে সশস্ত্র অপতৎপরতা চালায়। বরাবরের মতো প্রশাসন এসব ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
সেটলার বাঙালিদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনা তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, গত বছর সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের ওপর অন্তত ৬টি হামলা চালায়, ইউপিডিএফের এক সদস্যকে অমানুষিক শারিরীক নিপীড়ন চালিয়ে হত্যা করে এবং অন্য দুই পাহাড়িকে মারধর করে। এছাড়া সেটলারদের হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরে পাহাড়িদের ১১টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভূমি বেদখলের চিত্র তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে অন্তত ১৩টি স্থানে ভূমি বেদখল ও বেদখল চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯টি স্থানে সেটলার বাঙালিরা ভূমি বেদখল ও বেদখল চেষ্টা চালায় এবং বান্দরবানের লামায় ভূমিদস্যু রাবার কোম্পানি কর্তৃক পুনরায় দুই দফায় ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির ৪০০ একর জুমভূমি জবরদখল চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া লামা উপজেলার সাংগু মৌজায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ৫,৭৬০ একর জায়গায় ‘সাংগু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা’র নামে ভূমি থেকে স্থানীয়দের উচ্ছেদের ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ‘সীগাল বোর্ডিং স্কুল’ স্থাপনের নামে ভূমি বেদখলের পাঁয়াতারা চালায়। এর প্রতিবাদে স্থানীয় এলাকাবাসী মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল ও বেদখল প্রচেষ্টার ঘটনা ঘটলেও এর প্রতিকারে সরকার-প্রশাসন আইনগত কোন পদক্ষেপ নেয় না। উপরন্তু ভূমি বেদখলকারী সেটলার ও ভূমিদস্যুদের পক্ষাবলম্বন করে থাকে। এর ফলে পাহাড়িদের পক্ষে ভূমি বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে যাতে জনগণ প্রতিবাদ করতে না পারে তার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী নানাভাবে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে।
নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, ২০২৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত ২৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণসহ যৌন নিপীড়ন-সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১ জন, ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৯ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ১ জন এবং শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ১ জন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় এক পাহাড়ি নারী এনজিও কর্র্মীকে গলায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। সেটলার ও সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশ ও সেনা মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী ও কতিপয় পাহাড়ি দুর্বৃত্ত এসব নারী ওপর সহিংসতার ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত ছিল। ধর্ষণের ঘটগুলোর মধ্যে একটি বহুল আলোচিত ছিল রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে ৬ সেনা সদস্য কর্তৃক এক পাহাড়ি স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ। এই ঘটনার বিরুদ্ধে সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কিন্তু এরপরও অভিযুক্ত নিরাপত্তা সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি। উল্টো ঘটনা ধামাচাপা দিতে নানা কূটকৌশল প্রয়োগ করা হয়।
এতে আরো বলা হয়, উপরোক্ত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র চালানো হয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় খাগড়াছড়ির বিজিতলা ও গামারিঢালা এলাকায় ৩৩ পরিবার রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের তথ্য পাওয়া যায়। বিজিতলা আর্মি ক্যাম্পের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন ইয়াসিনের নেতৃত্বে অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে পাহাড়ি জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। কথিত উন্নয়নের নামে সরকার পাহাড়ি জনগণকে চারদিক থেকে এইসব সড়কের মাধ্যমে ঘিরে ফেলে তাদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের আয়োজন করছে। সরকার ও সেনাবাহিনী জনগণকে নিজেদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ এবং এলাকার জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে।
রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সংঘটিত ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী সমতলের চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে আগস্ট মাসে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হয়।
এছাড়া এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে আটক হওয়া এক পাহাড়ি যুবককে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করা হয় ও আরো কয়েকজন পাহাড়ি যুবককে সেনা-পুলিশের সহায়তায় আটক করে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।