রাঙামাটিতে ৩ কোটি টাকার পর্যটন উন্নয়নের নামে একটি প্রকল্পে কোনো কাজ শুরুই হয়নি। অথচ কাজ না করেই প্রথম অর্থবছরে পাওয়া বরাদ্দের টাকা ভুয়া বিলে উত্তোলণ করা হয়েছে। রাঙামাটি সদরের তবলছড়ি এলাকায় ‘লুসাই পাহাড়ে পর্যটন উন্নয়ন’ শীর্ষক এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
প্রকল্পটির কাজ ২০২৩ সালের জুলাই শুরু করে শেষ করার কথা ২০২৬ সালের জুনে। এর মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ কোটি টাকা, যার প্রথম অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এ প্রকল্পের কাজ আজ পর্যন্ত শুরুই হয়নি। এরপরও কাজের প্রথম ধাপে পাওয়া বরাদ্দের ১০ লাখ টাকা উত্তোলণ করা হয়েছে। এছাড়া রাঙামাটি শহরে অর্ধ কোটি টাকার আরেকটি রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে সিংহভাগ টাকা লুটপাট করে আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিনে তদন্তে এসব তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লুসাই পাহাড়ে পর্যটন উন্নয়নে কোনো কাজই করা হয়নি। কাপ্তাই হ্রদ পরিবেষ্টিত বিচ্ছিন্ন পাহাড়টি যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে আছে। পর্যটনের উন্নয়ন কাজে কোদালের একটি কোপও পড়েনি সেখানে। অথচ কাজের টেন্ডারসহ কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল এক বছর আগে। পাহাড়টিতে কয়েক পরিবারের বাড়িঘর দেখা যায়, যারা অনেক আগেই থেকেই সেখানে বসবাস করছিলেন বলে জানা যায়। এ সময় স্থানীয়রা জানান, ওই পাহাড়ে পর্যটন উন্নয়নে আজ পর্যন্ত কেউ কোনো রকম কাজ করতে যাননি। সেখানে যে পর্যটন উন্নয়নে কাজ করা হবে বা এ ধরনের কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা কারও কাছে কিছুই জানা নেই তাদের। কয়েকজন বলেন, পাহাড়টি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের এক সদস্যের নামে মালিক দান করে দিয়েছেন বলে শুনেছি।
এদিকে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রকৌশল শাখায় বিষয়টির খোঁজ নিতে গেলে একজন কর্মচারী জানান, প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে পাওয়া বরাদ্দের টাকার বিল গত অর্থবছরের জুন ফাইনালের আগে উত্তোলণ করা না হলে তো টাকা ফেরত যাওয়ার কথা। কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রকল্পের টাকা তো ফেরত গেছে বলে মনে হয় না। কাজেই সংশ্লিষ্ট কাজের ঠিকাদারের নামে বিলের টাকা হয় তো নিশ্চয় পরিশোধ হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তা (কোড-২২১০০০৯০০) আওতায় ২০২৩-২৪ অর্থবছর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ‘রাঙামাটি সদর উপজেলার লুসাই পাহাড়ে পর্যটন উন্নয়ন’ শীর্ষক ৩ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন পায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এ প্রকল্পের কাজের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুলাই হতে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। এতে প্রথম অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১০ লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে সরাসরি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, রাঙামাটি সদরের লুসাই পাহাড়ে পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০২২ সালে অনুমোদন পাওয়া যায়, যার কাজ ২০২৩ সালের জুলাই শুরু হয়েছে। সেখানে অনেক কাজ, তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ কোটি টাকা অনুমোদন করা হলেও পুরোপুরি কাজ করতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। প্রথম অর্থবছর পাওয়া বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। এ টাকায় কাজ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া জায়গাটির সীমানা নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে। সেটি সমাধানের প্রক্রিয়ায় আছে। তাই এখনো কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। সমাধান হয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে কাজ শুরু করা যাবে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি কটেজ নির্মাণ এবং পারাপারের জন্য ক্যাবল কার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। পাহাড়টি হ্রদে বিচ্ছিন্ন। সেতু নির্মাণের জায়গাও নেই। তাই ক্যাবল কার স্থাপন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। পাহাড়টি কারও ব্যক্তিগত নামে নেই। এটির মালিকানা এখন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। আগের মালিক বেকি লুসাই থেকে জেলা পরিষদ কিনে নিয়েছে।
এদিকে রাঙামাটি শহরের চম্পকনগরের ‘ওয়াপদা রেস্ট হাউসের দক্ষিণ পাশে অশিনী কুমার চাকমার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ’ শীর্ষক ৫০ লাখ টাকার আরেকটি প্রকল্পের কাজ সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সদ্য নির্মিত এ রাস্তাটির অবস্থা খুবই নড়বড়ে। প্রকল্পে সর্বোচ্চ ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে রাস্তাটি কিছু রড ও আরসিসি ঢালাই দিয়ে করা হলেও কাজ অত্যন্ত নিম্নমানের বলে জানান স্থানীয়রা। ফলে কাজ শেষ হতে না হতেই রাস্তার শুরুর দিকে সম্মুখ অংশ ধসে গেছে পুকুরের পানিতে। রাস্তাটি পাহাড়ের ওপর দিয়ে না করে নির্মাণ করা হয়েছে চম্পকনগর পুকুরের পাড় দিয়ে। আর এ রাস্তাটি করে উপকৃত হবে শুধু একটি পরিবার। এ প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুলাই শুরু করে শেষ করা হয়েছে চলতি সালের জুনে। স্থানীয়দের তথ্য মতে, এ কাজে অর্ধেক টাকাও খরচ করা হয়নি। সিংহভাগ টাকা লুট হয়ে গেছে জেলা পরিষদের প্রকৌশল শাখার লোকজন ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের পকেটে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়ুয়া বলেন, পাহাড়ের ওপর দিয়ে রাস্তাটি করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এতে কয়েকটি পরিবারের ঘরবাড়ি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে নিচের পুকুরের পাড় ঘেঁষে তা নির্মাণ করতে হয়েছে। ওই রাস্তাটি করে আশপাশের অনেকে উপকৃত হবেন। শুধু একটি পরিবারের উপকারে সেটি বিবেচ্য হয়নি। রাস্তাটির সম্মুখ অংশ ধসে যাওয়ার বিষয়ে তা দেখবেন বলে জানান তিনি।