৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়া পরেও রাঙামাটিতে লোক দেখানো উন্নয়নে পৌণে ৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে নির্মাণ করা হচ্ছে কেবল নামেই একটি কোল্ডস্টোরেজ। সেখানে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত ফলমুল ও কৃষিজ পণ্যদ্রব্য সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। রাঙামাটি শহরের নিউ মার্কেট সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ি ঝিরির ওপর সামন্য জায়গায় এ হিমাগারের স্থাপনাটি নির্মাণ করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।
সরেজমিন দেখা যায়, রাঙামাটি শহরের নিউ মার্কেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ অফিস ভবনের মাঝখানে একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ি ঝিরির ওপর সামান্য জায়গায় (আনুমানিক চার শতক) একটি পাকা স্থাপনা নির্মাণে কয়েকটি পিলার স্থাপনের কাজ চলছে। পিলারের লোহার রডসহ এ পর্যন্ত যতটুকু কাজ হয়েছে, তার সর্বোচ্চ ব্যয় ৫/৭ লাখ টাকা হতে পারে। সেখানে কাজ করতে দেখা গেছে মাত্র তিন শ্রমিককে। তাদের কাছে জিজ্ঞাসায় জানা গেল সেটিই পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণাধীন কোল্ডস্টোরেজ বা হিমাগার।
সেখানে যেভাবে শুরু করে কাজ চলছে তা শেষ করতে কোটি টাকাও ব্যয় হবে না বলে মন্তব্য করে স্থানীয়দের অনেকে বলেন, এ ধরনের কাজ করাই হলো আওয়ামী লীগ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামে লোক দেখানো উন্নয়নের নামে সরকারের টাকা লুট করার ফায়দা। রাঙামাটিতে এ ধরনের নামকাওয়াস্তে কাজে হিমাগার স্থাপন করে কৃষক বা সাধারণ মানুষের স্বার্থে কোনো কাজেই আসবে না। এটির পেছনে মূল টার্গেট ছিল সরকারের কোটি টাকা ফায়দা লোটার পরিকল্পনা। এটি দলীয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল, তাই কাজটি যিনি পেয়েছেন তিনি হলেন আওয়ামী লীগের লোক। গত ১৫ বছর ধরে এ ধরনের কাজের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজনের পাশাপাশি অঢেল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রকৌশলী, সহকারী ও উপসহকারী প্রকৌশলীসহ দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা। বিপরীতে সাধারণ মানুষ কারও ঠিকাদারির সুযোগ ছিল না। সুষ্ঠু তদন্তে এসব দুর্নীতির প্রকৃত তথ্যচিত্র প্রকাশ পাবে।
এদিকে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত ফলমুল ও কৃষিজ পণ্য-দ্রব্য সংরক্ষণে স্থানীয় কৃষকসহ সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল হিমাগার স্থাপন। তিন পার্বত্য জেলার কোথাও হিমাগার না থাকায় সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর উৎপাদিত আনারস, আম, কাঁঠাল, লিচু, কমলা, কলা, জামরুল, কাঁচা তরকারিসহ কয়েকশ’ কোটি টাকার ফলমুল ও কৃষিজ পণ্য পচে নষ্ট হয়ে যায়। তাই এসব উৎপাদিত পণ্য-দ্রব্য সংরক্ষণে তিন পার্বত্য জেলায় হিমাগার স্থাপনের দাবি ছিল এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের হিমাগার স্থাপনে দরকার বিশাল সমতল জায়গা। আর এতে নির্মাণ ব্যয় হবে অন্তত শতাধিক কোটি টাকা। কিন্তু তিন পার্বত্য জেলায় কোথাও এ ধরনের উপযোগী জায়গা খালি না থাকায় হিমাগার স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এটি নির্মাণ করতে হবে একটি বিশাল আয়তাকারের গুদাম, যা হবে একটি বৃহৎ আকারের কারখানা। এখানে লোকবলও পর্যাপ্ত লাগবে। এ অবস্থায় স্বল্প বা নগণ্য একটি জায়গায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পৌণে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন হিমাগারটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া বিষয়টি কারও কাছে জানাও নেই। অথচ এ ধরনের প্রকল্প নিতে হলে আগে বিশষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২ সালে ‘রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তা (কোড নং-২২১০০০৯০০) এর আওতায় প্রকল্পটির অনুমোদনসহ অর্থায়ন দিচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যার কাজের মেয়াদ ২০২৩-২০২৬ সাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু এ প্রকল্পে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। দরপত্র আহবান ও কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল ২০২৩ সালের জুনের পরে। এর মধ্যে চলতি কাজের জন্য প্রথম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ লাখ টাকা। বরাদ্দের এ টাকা চলতি বিল হিসাবে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার।
এ ব্যাপারে মতামত জানতে ফোনে যোগাযোগ করা হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তপন কুমার পাল বলেন, বিষয়টি তার কাছে জানা নেই। তিনি বিষয়টি নিয়ে উপপরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন।
পরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটির উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাঙামাটিতে কোথাও বা কারা হিমাগার স্থাপনার কাজ করছেন- তা আমি কিছুই জানি না। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড যদি তা স্থাপনার কাজ করে থাকে, কীভাবে কী রকম হিমাগার স্থাপন করছেন তারাই ভালো জানবেন।
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী তুষিত চাকমা বলেন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় একটি কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ৩০-৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ কাজের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত রয়েছে। স্থানীয় চাহিদার বিবেচনায় এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে দলীয় বিবেচনার কিছুই নেই। কার্যাদেশ দেওয়ার পর ঠিকাদার সিডিউল অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন। তাছাড়া এখানে অনিয়ম বা দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই।
কাজের ঠিকাদার ও জেলা যুবলীগ নেতা শফিউল আজম বলেন, রাঙামাটিতে কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ কাজটি আমি পেয়েছি। আমি সিডিউল অনুযায়ী কাজ করছি। এখানে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি নেই। বাকি বক্তব্য নির্মাতা সংস্থার নির্বাহী প্রকৌশলী বলবেন।