কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় ভাঙা বেড়িবাঁধ যেন দ্বীপবাসীর কাছে আতঙ্কের আরেক নাম। কয়েক দফায় বিলীন হয়েছে বসতঘর। সর্বস্বান্ত হয়েছে দ্বীপটির বহু বাসিন্দা। কিন্তু ৩৪ বছরেও টেকসই বেড়িবাঁধ পায়নি কুতুবদিয়াবাসী।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, কুতুবদিয়ায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৪০ কিলোমিটার, যার মধ্যে সাড়ে ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত। আর সম্প্রতি বিলীন হয়েছে ৮০০ মিটার বেড়িবাঁধ।
বিলীন কবলিত কুতুবদিয়ার সাগর তীরবর্তী বায়ু বিদ্যুৎ, তাবালেরচর, কাহারপাড়া, হায়দারপাড়া, তেলিপাড়া ও আনিছের ডেইল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখানকার বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। আশপাশে বাঁশ-কাঠ-পলিথিন ও টিনের ছাউনিযুক্ত ঝুপড়ি তৈরি করে বসতি করছে মানুষ। বাসিন্দারা জানান, মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ মাস উত্তাল থাকে সাগর। এখন সাগরের প্রবল জোয়ারে প্রতিনিয়ত বেড়িবাঁধ ভাঙছে।
আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের সাইটপাড়া গিয়ে দেখা যায়, জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু ঘর প্লাবিত হচ্ছে। একটি ঘরের উঠানের কিছু নারকেলগাছ সাগরে বিলীন হওয়ার পথে। যেখানে ছোট্ট একটি ঝুপড়িতে বাস করেন সত্তর বছরের বৃদ্ধা মরিয়ম বেগম। জীবনে তিনি ৫০টির বেশি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন বলে জানান।
২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে তিনি চার মেয়েকে হারিয়েছেন। মরিয়ম বেগম বলেন, সাগরে দিন দিন বিলীন হচ্ছে দ্বীপ। গত তিন দশকে বসতবাড়ি ও পেশা হারিয়ে দ্বীপের অনেক মানুষ অন্য স্থানে চলে গেছেন। যারা রয়ে গেছেন, সবাই আশায় বুক বেঁধে আছেন কখন একটি টেকসই বেড়িবাঁধ হবে।
মরিয়ম বেগম বলেন, ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের আগে তার বসতবাড়ি ছিল দুই কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মধ্যেই। তখন তার পাঁচ কানি (দুই একর) জমি ও বসতঘর ভেসে গিয়েছিল। গত তিন দশকে তিনি চারবার ঘর পাল্টিয়েছেন। এখন যে ঘরে থাকছেন, সেটিও জলোচ্ছ্বাসের প্লাবিত হয়। মরিয়ম বেগমের ছেলে ফরিদুল আলম বলেন, বর্ষাকালে কয়েক হাজার মানুষের চরম আতঙ্কে দিন কাটছে।
কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের ষাটপাড়ার ৫৫ বছর বয়সি মোস্তফা বেগম। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বসতভিটা হারানো পর বেড়িবাঁধে ঝুপড়ি ঘরে তার বাস। কিন্তু গত কদিনের প্রবল জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়েছে শেষ আশ্রয়স্থলটিও। এখন তিনি সর্বস্বান্ত।
মোস্তফা বেগম বলেন, স্বামী পাগল, কোথায় থাকে জানি না। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর বাস করতাম। কিন্তু সাগরের প্রবল জোয়ারে ঢেউয়ের আঘাতে ঘরটি বিলীন হয়ে গেছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে সাগরের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছি। আর পারছি না। আর শক্তি নেই। ঘরও সাগর নিয়ে গেছে। কোথাও যদি জমি থাকতো তাহলে ওখানে গিয়ে ঘর বেঁধে থাকতাম। কিন্তু ঘর বা ভিটা কিছুই তো আর নেই। এখন সর্বস্বান্ত।
এদিকে কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, কৈয়ারবিল, উত্তর ও দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নসহ ১২টি অংশে ভাঙা ছিল বেড়িবাঁধ। জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হলেও এক বছরও টেকে না। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বায়ুবিদ্যুৎ, তাবালেরচর, কাহারপাড়া, হায়দারপাড়া, তেলিপাড়া, আনিছের ডেইল এলাকা। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রতিনিয়ত ঢুকছে জোয়ারের পানি। প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, গত দেড়-দুই দশকে প্রতি বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। কুতুবদিয়া দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আযাদ বলেন, কুতুবদিয়া বেড়িবাঁধ নির্মাণ নিয়ে অনিয়ম রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এটা নাহলে কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধের এ অবস্থা হতো না। কুতুবদিয়ার মানুষের এ দুর্ভোগ হতো না।
আলাউদ্দিন আল আযাদ আরও বলেন, গত তিন দশকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কিংবা পেশা হারিয়ে শত শত মানুষ দ্বীপ ছেড়েছেন।
কক্সবাজার বাপাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জামাল মুর্শিদ বলেন, চলমান অতিবৃষ্টি সঙ্গে সামুদ্রিক সিগ্যানালের কারণে কুতুবদিয়ায় বেড়িবাঁধের প্রায় ২.৫ কিলোমিটার স্থানের ১২টি অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারমধ্যে ৫টি অংশে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে কাজ করা হয়েছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও মাতারবাড়ীর জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আলী আকবর ডেইল ইউনিয়ন ও বাতিঘর এলাকায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করছি। দ্রুত একটি জমা দেওয়া হবে।