১৯৯৬ থেকে ২০২২। মাঝে ২৬ বছর। কাপ্তাই হ্রদে গড়িয়েছে অনেক পানি। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে ওপর থেকে দেখলে সেই লেকের মতোই গভীর দেখায়। কিন্তু তিন দশকে জমা ‘ক্ষোভের পলি’তে ভরাট হয়ে আসা তলদেশ বেরিয়ে আসে নির্বাচনী মৌসুম এলেই। তাই রাঙামাটিজুড়ে জল্পনা- এবার কি হাওয়া লাগবে পরিবর্তনের পালে? নাকি আবারও নেতৃত্ব পাবেন জেলা আওয়ামী লীগে দীর্ঘদিনের একক কর্তৃত্বে থাকা সভাপতি ও সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আগামীকাল মঙ্গলবার। সম্মেলনে সভাপতি পদে লড়ছেন দলটির বর্তমান সভাপতি দীপংকর তালুকদার এবং সহসভাপতি নিখিল কুমার চাকমা। সাধারণ সম্পাদক পদে লড়ছেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বর ও কামাল উদ্দিন। জেলা আওয়ামী লীগের এবার সম্মেলনে কাউন্সিলর হয়েছেন ২৪৬ জন।
জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে না পারলেও স্বাধীনভাবে মনোভাব প্রকাশের সুযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা দীপংকরের সিদ্ধান্তের বাইরেই অবস্থান নেন। দীপংকর নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে না পড়লেও তার অনুসারীরা হেরেছেন কিংবা ‘এন্টি দীপংকর’ অংশটিই বারবার জিতে গেছে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে- এবার নিজে জিতবেন তো দীপংকর?
নেতাকর্মীদের ‘দীপংকরবিরোধী মনোভাব’ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১২ সালের যুবলীগের সম্মেলনে। আলোচনা আছে- ওই কাউন্সিলে সভাপতি পদে দীপংকর তালুকদারের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন মুজিবুর রহমান দীপু। কিন্তু কাউন্সিলররা নির্বাচিত করেছেন বর্তমান মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীকে। ওই পদে থেকেই আকবর হোসেন চৌধুরী ২০১৫ সালে রাঙামাটি পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে প্রথম দলীয় মনোনয়ন চান। কিন্তু দীপংকর তালুকদারের স্বাক্ষর করা জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে কেন্দ্রে পাঠানো দলীয় প্রার্থীদের তালিকায় আকবরের নাম ছিল শেষের দিকে। তবু শেষ পর্যন্ত আকবর হোসেন চৌধুরীই দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে মেয়র হন। সর্বশেষ ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনেও ঘটে একই ঘটনা। আর দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দ্বিতীয় দফায় আকবর হোসেন চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হন। আছেন জেলা যুবলীগের সভাপতির পদেও।
২০১৫ সালের ২ জুন রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি পদে দীপংকরের অনুসারী সাইফুল আলম রাশেদ ও মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীর অনুসারী আবদুল জব্বার সুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নিয়ে দুপক্ষের সংঘাত হলে শেষ পর্যন্ত আবদুল জব্বার সুজনকে সভাপতি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। আর সাইফুল আলম রাশেদ পান সহসভাপতির পদ। এখনো চলছে দুপক্ষের সেই বৈরিতা।
১৯৯৬ সালের সম্মেলনের পর থেকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এককভাবে সভাপতি হয়ে আসছেন দীপংকর তালুকদার। সর্বশেষ ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে দীপংকর তালুকদার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। অভিযোগ আছে- দীপংকর দলে এতবেশি প্রভাব তৈরি করেছেন, প্রকাশ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা কথার বাইরে চলার সাহস দেখাননি নেতারা। তবে সাধারণ সম্পাদক পদে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকায় সেই ঝাল মিটিয়েছেন কাউন্সিলররা। দীপংকরের মনোনীত প্রার্থী তখনকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কামাল উদ্দিনকে হারিয়ে দীপংকরের ‘মুঠোর বাইরে’ থাকা মুছা মাতব্বরই জয়ী হন সাধারণ সম্পাদক পদে। অবশ্য পরে সেই অম্লমধুর সম্পর্ক ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরান দীপংকর ও মুছা।
অভিযোগ আছে, এককালের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমাকে দ্বিতীয় মেয়াদে চেয়ারম্যান হতে দেননি দীপংকর। ২০২১ সালের ১৩ জুন নিখিল কুমার চাকমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয় সরকার। কিন্তু সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হতে সময় লেগে যায় মাসখানেক। এতে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রটে, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে দিতেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন দীপংকর তালুকদার। ফলে দীপংকর-নিখিলের সেই দ্বৈরথ জেলা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এখন প্রকাশ্যে এলো।
১৯৯১ সালে প্রথমবার নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়েই বিজয়ী হন দীপংকর তালুকদার। এর পর থেকেই দলে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেন। তবে পাঁচবারের সংসদ সদস্য নির্বাচনে বিজয়ী হন তিনবার। ১৯৯৬ সালে জয়ী হলেও পরাজিত হন ২০০১ সালে। ২০০৮ সালে জয়ী হয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের। ২০১৪ সালে সরকারের মন্ত্রী থেকেও নির্বাচনে জনসংহতির উষাতন তালুকদারের কাছে পরাজিত হন দীপংকর। ২০১৮ সালে আবার জয়ী হলেও মন্ত্রিত্ব পাননি।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, দলের বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে মূলত রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। সেখানে দীপংকর একক সিদ্ধান্তে তার আস্থাভাজনদেরই ঘুরেফিরে নিয়োগ দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া একক কর্তৃত্বে উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি, নিয়োগ, নতুন ও বিকল্প নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তার বলছেন, ‘একক সিদ্ধান্তে এত বড় দল চলতে পারে না’। সম্মেলন নিয়ে তাই জেলা কমিটি আজ দুই ভাগে বিভক্ত।
এদিকে প্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলররাও কষছেন নানান হিসাব-নিকাশ। নেতৃত্ব নিয়ে নানান চিন্তাভাবনার কথা বললেও নিজের নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না কাউন্সিলররা। তারা বলছেন, সব প্রার্থীই হেভিওয়েট। আমরা সব প্রার্থীর সঙ্গেই বসছি, কথা বলছি। তবে কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে কারোর বিদ্বেষভাজন হতে চাচ্ছি না।
নিখিল অনুসারী হিসেবে পরিচিত দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন গণতন্ত্র চর্চার অভাবে দলে একটি একঘেয়েমি ভাব এসেছে। পরিবর্তন আনা দরকার।
অন্যদিকে দীপংকর তালুকদারের অনুসারী রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও কাউন্সিলর রফিক আহমদ বলেন, দীপংকর তালুকদার ছাত্রলীগ থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে কয়জন প্রতিবাদ করেছে দীপংক তাদের অন্যতম। তিনি রাঙামাটির আওয়ামী লীগকে আধুনিক ও সুসংগঠিত করেছেন। দীপংকর জনমানুষের নেতা, তাকে বারবার নির্বাচিত করা দরকার। এখানে তার প্যারালাল নেতা এখনো কেউ তৈরি হয়নি।
দলের নেতাকর্মি ও কাউন্সিলররা নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ে যে ভাবনাই ভাবুক, নেতৃত্বের লড়াইয়ে ভোটের মাঠে এগিয়ে থাকতে নানাভাবে ব্যস্ত সময় পার করছেন সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থিরা।
দীপংকর তালুকদার বলেন, সম্মেলন নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি শেষ। নিখিলের প্রার্থিতার বিষয়ে তিনি বলেন, আরও কে কে প্রার্থী হচ্ছেন তা সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে জানা যাবে।
নিখিল কুমার বলেন, ‘দলের নেতাকর্মী ও কাউন্সিলররা আমাকে সভাপতির পদে প্রস্তাব করেছেন। তাদের প্রতি সম্মান রেখে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দল সুগঠিত করার লক্ষ্যে কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নেবে আমি তা মেনে নেব।
মুছা মাতব্বর বলেন, আমি দল থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। আরও একবার সাধারণ সম্পাদক পদে সুযোগ চাচ্ছি। কাউন্সিলরদের যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি। আমার এখন সময় এসেছে দলকে কিছু দেওয়ার। এবার দায়িত্ব পেলে দলকে আরও গতিশীল করব।
অন্যদিকে কামাল উদ্দিন বলেন, আমি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলাম। নিজের জন্য ভোট চাচ্ছি। আমার কাছে অভিযোগ এসেছে- মুছা টাকা উড়াচ্ছেন। তবে আমি কাউন্সিলরদের প্রতি আস্থা রাখতে চাই।