মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলছে পাহাড়ে বসবাস করা গুর্খা জনগোষ্ঠীরা। মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারেন ৫০ থেকে ৬০ জন। এরা না থাকলে বাকীরা হারাবে মাতৃভাষা।
রাঙামাটি শহরের মাঝের বসতি, আসামবস্তি এলাকায় বসবাস করেন গুর্খা জনগোষ্ঠীর লোকজন। রাঙামাটিতে প্রায় ১০০ পরিবার গুর্খা পরিবার বসবাস আছে। অন্য দুই বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাসহ অন্যান্য এলাকায় আছে সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ পরিবার।
দেশের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর তালিকায় ২০১৯ সালে স্থান পায় গুর্খা জনগোষ্ঠীরা। গুর্খা জনগোষ্ঠী নিয়ে সরকারী কোন জরিপ নেই। তবে গুর্খাদের নিজস্ব জরিপ মতে এদের জনসংখ্যায় প্রায় দেড় হাজার।
মনোজ বাহাদুর গুর্খা (৬৬) বলেন, গুর্খাদের ভাষা সংস্কৃতির অবস্থা বেশ খারাপ। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে অধিকাংশ। আমরা যারা ৫০-৬০ জন আছি তারা গুর্খালী ভাষায় কথা বলতে পারি। আমরা না থাকলে আমাদের ছেলেমেয়রা অন্য ভাষায় কথা বলবে। তারা মাতৃভাষাটিই হারাবে।
লিলাদেবী নেওয়ার (৭২) বলেন, গুর্খাদের নাম সরকারী তালিকাভুক্তি না থাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সুবিধা নিতে এর আগে কেউ চাকমা, কেউ ত্রিপুরা, কেউ মারমায় নিজেদের নাম লিখান গুর্খারা।
মনোজ বাহাদুরের লেখা পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খা জনগোষ্ঠীর বই থেকে জানা যায়, গুর্খা জনগোষ্ঠী থেকে স্নাতক ও স্নাতোকত্তর পাস করেছেন ১২ জন। শুধু স্নাতক পাস করেছেন ১০ জন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন ৯ জন। এ জনগোষ্ঠী থেকে ডাক্তার আছে ২ জন। সবমিলে সরকারী চাকুরি করছে ৩০-৪০ জন। আইনজীবী আছেন ১ জন। গুর্খারা কেউ সনাতন, কেউ বৌদ্ধ ধর্ম পালন করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ডের মত গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানে গুর্খাদের কোন কোটা সংরক্ষণ করা হয়নি।
জানা যায়, ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ শাসক লুসাই বিদ্রোহ দমন করতে ব্রিটিশ ভারত ও নেপাল থেকে সেকেন্ড গুর্খা রেজিমেন্টকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। এদের খাগড়াছড়ির দিঘিনালা ও রাঙামাটির লংগদুর মাঝামাঝি মাইনী ভ্যালীতে পুনর্বসান করা হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় এ গুর্খাদের মধ্যে অধিকাংশ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেও কিছু অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে থেকে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরবর্তী গুর্খাদের মধ্যে অনেকে সরকারী চাকরী করলেও বর্তমানে এ সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছে। গুর্খারা কেউ সনাতন, কেউ বৌদ্ধ ধর্ম পালন করেন। উচ্চ শিক্ষিতরাও হারিয়েছেন মাতৃভাষা।
নানিয়াচর সরকারী কলেজের প্রভাষক হিমাদ্রী বাহাদুর বলেন, রাঙামাটিতে এক পরিবেশে বড় হয়েছি। তখনও মাতৃভাষা শিক্ষার চ্যালেঞ্জ ছিল। উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে পাশে কোন গুর্খাকে পাইনি যে আমার সাথে গুর্খালী ভাষায় কথা বলবে। ফলে হারিয়েছি মাতৃভাষাটি।
রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক রুনেল চাকমা বলেন, পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর তালিকায় সর্বশেষ গুর্খাদের অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। এর আগে তারা আসলে অবহেলিত জনগোষ্ঠী ছিল। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীতে তালিকাভুক্ত হবার পর একবার গুর্খা জনগোষ্ঠীর সাথে বসেছি। তারা এখনো সমস্যা চিহ্নিত পর্যায়ে রয়েছে। এদের ভাষা সংস্কৃতি রক্ষায় জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি লাগবে।
রাঙামাটিতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখো, খিয়াং, গুর্খাসহ ৭টি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এদের জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট গুর্খা নৃ গোষ্ঠী।