জন্ম-বেড়ে উঠার গল্প সবই মহালছড়িতে। মহালছড়িকে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মন্দ খবর শুনলে, দেখলে যেমন ব্যথিত করে, একইভাবে ভালো খবর দেখলে খুশিতে মন ভরে উঠে। এমনি এক খুশির খবর দিয়ে আমাদের সহপাঠী বন্ধু অংশুমান দেবনাথ একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছে। পড়তে গিয়ে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এ কি এমন খুশির খবর! কিন্তু আমরা যারা মহালছড়িতে থাকি, মহালছড়িকে নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখি, তাদের জন্য খবরটি অন্য রকমের।
বন্ধুটি থলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সে প্রায়ই তার স্কুলে বন্যার ছবি দিয়ে পোস্ট করে। বন্যায় ক্লাশ না করতে পারার খবর দেয়। স্কুলটি খুব সুন্দর একটি লোকেশনে, একেবারে মহালছড়ি প্রবেশ মুখে ও রাস্তার পাশে।
২৪ মাইল তার স্কুল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এখানেও একটি কলেজ আছে। এই কলেজটিও বর্ষার মৌসুমে ডুবে। আকস্কিক বন্যায়, পাহাড়ি ঢলেও ডুবে। কিন্তু কলেজ ডুবে থাকলেও কাউকে কলেজ নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা যায় না। কলেজকে ঘিরে যাদের জীবন-জীবিকা, পরিচয় তাদের অধিকাংশই বাইরের। খুব কম শিক্ষককে পাওয়া যাবে, যিনি মহালছড়িতে টানা এক সপ্তাহ অবস্থান করছেন, করেছেন। মহালছড়িকে নিয়ে তাদের চিন্তার বদলে, দিনের নির্ধারিত কাজ শেষ করে কিভাবে দ্রুত খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি কিংবা রাউজান, রাঙ্গুনিয়ায় ফিরে যাওয়া যায়, তা নিয়েই হুড়োহুড়ির দেখা মিলবে। বড় সত্য হলো, কলেজটি সরকারিকরণ হয়েছে। কলেজটি সরকারিকরণ হওয়ায় কর্তৃপক্ষের খুব একটা মাথা ব্যাথা থাকার কথাও নয়।
দুটি প্রতিষ্ঠানের পাশ দিয়ে একটি সুন্দর প্রাকৃতিক ছড়া আছে। পানি প্রবাহের লক্ষে সৃষ্ট, এ ছড়াকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দুপাশে বেশ কয়েকটি পাড়া আর রয়েছে চাষযোগ্য জমি। ছড়া পানি নির্ভর দুপাশে জমিগুলোতে এক সময় দুই-তিন ফসল চাষ হতো। এখন সেদিন আর নেই। বন উজাড়ের পাশাপাশি ছড়াতে ময়লা-আবর্জনা, দখল, ভরাট হয়ে প্রায় মরতে বসেছে।
শুষ্ক মৌসুমে ছড়ার পানি তলানিতে ঠেকে। আর বর্ষা মৌসুমে, অতি বৃষ্টিতে, ছড়ার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাঁধা প্রাপ্ত হলে এলাকায় বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
দেরিতে হলেও ছড়াটির খনন কাজ হচ্ছে তাই বন্ধুটি খুশি। ছড়া খননের কাজ সুন্দর হলে তার স্কুল বাঁচবে, কলেজও ডুববে না। ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত হবে না।
আমার এই বন্ধুটি আমার মতোই একটু বেশি পরিবেশ সচেতন, প্রকৃতি প্রেমী। মহালছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিমার্ণের নামে পাহাড় কাটতে দেখে, সাজেকে বেড়াতে গিয়ে পর্যটকদের পরিবেশ বিরোধী পলিব্যাগের ব্যবহার দেখে মর্মাহত হয়ে সচেতনতা আনতে তাকে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করতে দেখেছি।
পাহাড়ের ছড়া আমার লেখালেখির একটি বড় ক্ষেত্র। পাহাড়ে ছড়া, ঝর্ণা বাঁচানোর আবেদন খুব সম্ভবত আমিই প্রথম শুরু করি [দেখুন, ঞ্যোহ্লা মং, পাহাড়ে মূল্যবোধের চর্চা, ২০২১; মং এন্ড আলম, Indigenous People in CHT face water crisis, The daily Star,18, June, 2004, এছাড়াও ২০০৩-৭ সালে প্রথম আলো সহ বিভিন্ন পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, সংরক্ষণের অভাবে হারিয়েছি] সে সময়ে ছড়া, ঝর্ণাকে নিয়ে লিখতাম বলে, সহকর্মীরা হাসাহাসি করতো।
আমাদের অযত্ন অবহেলায় মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রকৃতির প্রতি অবহেলার দরুণ পাহাড়ে পানি সংকট বেড়েছে। নারীদের পানি সংগ্রহের দুর্ভোগ বেড়েছে। পাহাড়ি ঢল বেড়েছে। পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু, বছরের একটি নিয়মিত খবরে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালের আগে আমরা কখনো শুনিনি পাহাড়ে, পাহাড় ধসে মানুষ মরেছে।
আমাদের অযত্ন অবহেলায় প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। মহালছড়িতে ২৪ মাইল থেকে চেঙ্গী নদী পর্যন্ত প্রবাহিত ছড়াটি খনন কাজ করতে কত বাজেট, কি গবেষণা হয়েছে কিছুই জানি না। তবে এই ছড়াটির খনন কাজ হলে মহালছড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। দুটি প্রতিষ্ঠানসহ, পাড়াবাসীরা উপকৃত হবে।
ফেসবুক পোস্টটি দেখে খুশির পাশাপাশি আমার ভয় হলো, ছড়া খনন করতে গিয়ে যেন, ড্রেনে পরিণত করা না হয়। খাগড়াছড়িতে দেখেছি, অপর্ণাচরণ পাড়া আর পানখাইয়াপাড়া রোডের ছড়াটি খনন, উন্নয়নের নামে যা করা হয়েছে তা ড্রেনই করা হয়েছে। ছড়া খনন বা ছড়ার উন্নয়ন কোনটিই হয়নি। খেয়াল করলে দেখবেন, ছড়া হয় প্রাকৃতিকভাবে যৎসামান্য একটু ঢালু থেকে ঢালু। ছড়াতে পানি আটকে থাকে না। আটকে থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্ত খাগড়াছড়িতে ছড়াগুলোকে শহরের ড্রেনের ন্যায় ইট পাথর দিয়ে ঢেকে দিয়ে পুরোপুরি ড্রেন করে রাখা হয়েছে। এখানে পানির কোন প্রবাহ নেই। বড় রকমের বৃষ্টি, বা পানি প্রবাহের শক্তি না থাকলে আবর্জনা জমে পানি জমা হয়ে পড়ে থাকে। সামনে পিছনে ছড়াকে সমান সমান্তরালভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পানি আটকে থাকে। খাগড়াছড়ি গেলে দেখে আসুন, ময়লা আবর্জনার ড্রেনে পরিণত হয়ে, পঁচে আশপাশ বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশে পরিণত করা হয়েছে।
আমি অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাডিলেড শহরে প্রাকৃতিক ছড়াগুলোকে উন্নয়ন করতে প্রাকৃতি গঠন ঠিক রেখে ঢালুগুলোকে ঠিক রেখে নিমার্ণ হতে দেখেছি। সেখানে পানি আটকে থাকে না। পানি প্রাকৃতিকভাবে যেভাবে প্রবাহিত হতো, সেভাবে হতে দেখেছি। আরো একটি কথা, খাগড়াছড়িতে ছড়াকে শুধু ড্রেনে পরিণত করা হয়নি. ছড়াকে দুই পাশে দুটি দেয়াল দিয়ে সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যা বন্যায়, বৃষ্টিতে পানির পরিমান বেড়ে গেলে সৃষ্ট ছড়ার ওয়ালটি পানি প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ ড্রেনকে পানি প্রবাহের মাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি, ছড়ার পাড়কে ছড়া পাড়ের মতো খোলা এবং ওয়ালের কাঠামোটি মেলে দেয়া হয়েছে। এতে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলেও কোন বাঁধা তৈরি করবে না।
মহালছড়ির থলিপাড়ার ছড়া খননের কাজটি করতে গিয়ে যেন ড্রেনে পরিণত করা না হয়। প্রাকৃতিক গঠন, প্রাকৃতিক ঢালুকে যেন নষ্ট করা না হয়। নয়তো উন্নয়নের চাইতে অনুন্নয়নই হবে। আমাদের দুর্ভোগ বাড়াবে। প্রয়োজনে আরো গবেষণা হোক। এই ছড়াকে ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনাকেও আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। সংশ্লিষ্ট সকলকে আমার ভাবনাগুলো ভেবে দেখার অনুরোধ করবো।
— কলাম লেখক। ইমেইল : nyohlamong2@gmail.com
ছবি: অংশুমান দেবনাথ