বান্দরবানে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বছর খানিক ধরে শুষ্ক মৌসুম আসলেই দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের তাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত পানির সংকটে পড়তে হচ্ছে।
মূলত প্রতিনিয়ত কিছু অসাধু চক্র দীর্ঘ বছর ধরে সংরক্ষিত বন জঙ্গল থেকে গাছগাছালি কর্তন ও পাথর উত্তোলনের ফলে সেই ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার পানি শূন্য হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে ওইসব এলাকার জনগোষ্ঠীদের পানির জন্য হাহাকার করতে হচ্ছে। কিছু জায়গায় পানি থাকলেও এক কলসি পানির জন্য ১ থেকে ২ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়। সেই পানি সংগ্রহ করতে উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তায় দীর্ঘ মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে পানির সংকটের কারণে অন্যত্র চলে যেতে হবে এমনটিই জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। সরেজমিনে দেখা যায়, শহর থেকে ৫কি.মি দূরত্ব টিএনটি পাড়া, টাইগার পাড়া এলকায় চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের বসবাস আর চিম্বুক সড়কে ম্রলং পাড়া, হেডম্যানপাড়া, যামিনীপাড়া বসন্ত পাড়া, ওয়াই জংশন, ১২ মাইলসহ ওই এলাকায় ৯০ শতাংশ ম্রো সম্প্রদায়ের বসবাস।
সেই দুর্গম এলাকার গ্রামগুলোতে তীব্র পানি সংকটে পড়েছে। সেই এলাকাগুলিতে প্রায় ঝিরি-ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। দেখা গেছে, কোথাও ঝিরির শেষ মাথায় অল্প পরিমাণ পানি জমা আছে। সেই পানি সংগ্রহ করতে বিশেষ করে মহিলারা প্রায় ২ হতে ৩ ঘন্টা মাথায় কলসি কিংবা থুরুং বোঝা নিয়ে পানি সন্ধানে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে তাদের। কিছু জায়গা পানির দেখা মিললেও সেই পানি আবার ময়লা-আবর্জনা ভরা। এই পানি পান করলে ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, টাইফয়েডসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এভাবেই চলে শুষ্ক মৌসুমে তৃষ্ণা মিটানোর জন্য পানির যুদ্ধ।
এসব দুর্গম এলাকায় বসবাসরত ভুক্তভোগীরা জানান, যুগযুগ ধরে দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীরা বিভিন্ন ঝিরি-ঝর্ণা ও পাহাড় ডিঙিয়ে কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক সহ নানান পোঁকা-মাকড় আহরণ করে খাদ্যাভাস মেটাতেন। সেই ঝিরি-ঝর্ণায় পানির উৎসের স্তর কমে গিয়ে বিপন্ন হচ্ছে কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, বিভিন্ন পোকা-মাকড় আর কয়েক প্রজাতির মাছ ও প্রাকৃতিক শাক-সবজি।
অর্থের লোভে কিছু অসাধু চক্র প্রতিনিয়ত ঝিরি-ঝর্ণা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন আর বন-জঙ্গল উজাড়ের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে পাহাড়ের জীব-বৈচিত্র। শহর থেকে ৫কি.মি. দূরত্ব টিএনটি গ্রামের বাসিন্দা উম্রাচিং মারমা সহ বেশ কয়েকজন জানান, সেখানে ৫০ টি পরিবারের মধ্যে বেশিরভাগ জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল।
শুষ্ক মৌসুম আসলেই বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। পাহাড়ে চূড়া থেকে প্রায় তিন ঘন্টায় পায়ে হেঁটে খোয়া মধ্যে পানির সন্ধান মিললেও সেই পানি ব্যবহারের একেবারে অনুপযোগী।
চিম্বুক সড়কে টংকাবতী ব্রিকফিল্ড পাড়া বাসিন্দা তোয়েং ম্রো বলেন, আমাদের পাড়ায় পানির প্রচুর কষ্ট। প্রায় সময় পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া, পানির কোন ভালো উৎস নেই।
যার ফলে পানি শুকিয়ে গেছে। কিছু স্থানে আবার পানি পাওয়া গেলেও খুব গন্ধ। তবুও বাধ্য হয়ে পান করতে হচ্ছে। আরেক রামরীপাড়ার বাসিন্দা মেনরুন ম্রো বলেন, ঝিড়ি থেকে পানি আনতে আসা-যাওয়ায় প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এক মগ পানি সংগ্রহের জন্য আট মিনিট থেকে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়।
তাছাড়া পানির অভাবে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিয়মিত গোসল করা যায় না, যারা জুম কাজে যায় যে যেখানে পানি পায় সেখানে গোসল করে আর ফেরার সময় অল্প পানি পেলে সেটাই বাড়িতে নিয়ে আসি।
এই পানির সংকটের কারণে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। সমাজের কিছু দুষ্চক্র নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নির্বিচারে পাহাড় থেকে বৃক্ষ ও পাথর নিধনের ফলে পাহাড়ের পানির উৎসগুলো দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর শুস্ক মৌসুম আসলে এর খেসারত দিতে হয় খেতে খাওয়া সাধারণ মানুষকে এমন কথা জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
বান্দরবান দুর্নীতি প্রতিরোধ সভাপতি অংচমং মারমা বলেন, বছর খানিক ধরে চিম্বুক সড়কের অধিকাংশ পাহাড়ি গ্রামে তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নির্বিচারে ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন, বন উজাড়ের ফলে প্রকৃতি এখন ধ্বংসের পথে। প্রশাসন ও সর্বস্তরের মানুষ যদি এই জলবায়ুকে সঠিক রাখতে না পারে তাহলে ভবিষ্যতে পাহাড়ের অবস্থা আরো কাহিল হয়ে পড়বে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান চ্যাপ্টারের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, আমাদের দেখা, একসময় প্রায় তিনশত হতে চারশত ঝিরি- ঝর্ণা জীবন্ত যেখানে বারো মাস পানি পাওয়া যেত সেখানে এখন আর পানি নেই। গাছ কাটার যে মহোৎসব তার পাশাপাশি উন্নয়নের নামে যেসব পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে আগামী পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে বড় বড় পাহাড় ও ঝিড়িগুলো শুকিয়ে যাবে তার কোন সন্দেহ নেই। এখন জলন্ত প্রমাণ, পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম এলাকার গ্রামগুলো পানির জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে।
আগামীতে এই পানির সংকটের প্রভাবে পাহাড়িরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে এটাই শুধু দেখার বাকি থাকবে।
বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: মাহবুবুল ইসলাম বলেন, নির্বিচারে পাহাড়কে ধ্বংস করার কারণে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। পাথর উত্তোলন করার কারণে পাথরের গায়ে পানি লেগে থাকতে পারছে না। যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখতে না পারার কারণে দিনদিন পানি হ্রাস পাচ্ছে। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে ভবিষ্যতে পাহাড়ের সমস্যা দেখা দিবে। তাই আগামীতে আমাদেরকে এই বিষয় নিয়ে আরো সচেতন থাকতে হবে বলে মত দেন।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী শর্মিষ্টা আচার্য্য জানান, দুর্গম এলাকায় পাথরের কারণে টিউবওয়েল স্থাপন করা যায় না, সেখানে রিংওয়েল স্থাপন এবং যে সকল ঝিড়িতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে সেখানে বরাদ্ধ সাপেক্ষে জিএফএস পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।