শুক্রবার , ১৯ মে ২০২৩ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. জাতীয়
  2. রাঙামাটি
  3. খাগড়াছড়ি
  4. বান্দরবান
  5. পর্যটন
  6. এক্সক্লুসিভ
  7. রাজনীতি
  8. অর্থনীতি
  9. এনজিও
  10. উন্নয়ন খবর
  11. আইন ও অপরাধ
  12. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
  13. চাকরির খবর-দরপত্র বিজ্ঞপ্তি
  14. অন্যান্য
  15. কৃষি ও প্রকৃতি
  16. প্রযুক্তি বিশ্ব
  17. ক্রীড়া ও সংস্কৃতি
  18. শিক্ষাঙ্গন
  19. লাইফ স্টাইল
  20. সাহিত্য
  21. খোলা জানালা

একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রস্থানের আমার অনুভূতি

প্রতিবেদক
সোনা মনি চাকমা
মে ১৯, ২০২৩ ৬:২৬ অপরাহ্ণ

আমার পরমশিক্ষাগুরু মহালছড়ি উপজেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ শিক্ষক বাবু মংসাথোয়াই মাস্টার বার্ধক্যজনিত কারণে ১৬মে ২০২৩ তারিখে ৯২ (বিরানব্বই)বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন ।সুদীর্ঘকাল কর্মনিষ্ঠা, আন্তরিকতা দিয়ে শিক্ষকতায় নিবেদিত প্রাণ এ মহান শিক্ষকের পরশপাথরের হাতের ছোঁয়ায় মহালছড়ি উপজেলার অজস্র ছাত্রছাত্রী পেয়েছে আলোকিত জীবন ।বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি পরম শিক্ষাগুরুর প্রতি ।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়ি উপজেলা অজপাড়া গাঁ চোংড়াছড়ি মুখ এলাকা। এ এলাকায় চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের চির সম্প্রীতির অনন্য বন্ধনে প্রায় আড়াই’শ পরিবার লোক বসবাস করে।
সত্তরের দশকে এ এলাকায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না।ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল এ জনপদ।আশির দশকে প্রথমার্ধে স্থানীয় মুরব্বি বাবু নিরঞ্জন চাকমা ওরফে ধাজ্যা কর্তৃক দানকৃত ভূমিতে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে স্থাপন করা হয় চোংড়াছড়িমুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ।চারদিক বনজঙ্গলবেষ্টিত পাহাড়ে ছনের ছাওয়া ও বাঁশের বেড়ার তৈরি দুর্বল অবকাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত স্কুলের কোনো চেয়ার ,টেবিল, বেঞ্চ কিছুই ছিল না। এ বিদ্যায়তনে বিছানো বস্তায় উপবেশন করে আমার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেছিলাম ।প্রতিদিন নিজ দায়িত্বে ছাত্রছাত্রীরা বস্তা এনে তা বিছিয়ে তার ওপর বসে দৈনন্দিন পাঠগ্রহণ করতে হতো। পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বেঞ্চে বসে পাঠগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল । এমন দুঃখ – দুর্দশাপূর্ণ ও দুরবস্থার মধ্যে এলাকার শিক্ষার আলো জ্বালাবার মহান ব্রত নিয়ে বাবু মংসাথোয়াই মাস্টার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক শিক্ষার স্তরটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । প্রাথমিক শিক্ষা একটি বহুতল বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তির সঙ্গে তুলনা করা যায়। বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশনের ভিত দুর্বল হলে ওপর তলায় ফাটল ধরবে এটাই স্বাভাবিক। উচ্চ স্তরে যেন ফাটলের সৃষ্টি না হয় ,পশ্চাৎপদ এলাকার আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার শক্ত বুনিয়াদ গড়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় বাবু মংসাথোয়াই মাস্টার ।যার ফলে এ বিদ্যালয় বেশিরভাগ ছাত্রই জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে সমাজে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন । সবুজ পাহাড়ের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মানসে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও অফুরন্ত কর্মোদ্দীপনা নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তাঁর সময়ানুবর্তিতা ,কর্তব্যনিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের দৃষ্টান্ত সত্যিকারভাবে নতুন প্রজন্মের শিক্ষক সমাজের জন্য অনুসরণযোগ্য ।স্কুল গমনোপযোগী এলাকার ছেলে মেয়েদের যথাসময়ে স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা এবং বারংবার তাগিদ দেওয়াসহ প্রয়োজনে অপ্রিয় বাক্যও ব্যয় করতে দ্বিধা করেননি ।নিজ এলাকার শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে বিবেকের তাড়নায় তিনি এ কাজগুলো করতেন ।সকল ছাত্রছাত্রীদের নিজের ছেলেমেয়ে মনে করে আন্তরিকতার সঙ্গে পড়াতেন।মনে পড়ে- আমাদের সময়ে পঞ্চম শ্রেণি অধ্যয়ন শেষে উপজেলা পর্যায়ে একটি সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হতো। সে পরীক্ষায় যাতে সকলে পাশ করতে পারে সকল ছাত্রকে (আমাদের ক্লাসে ছাত্রী ছিল না)নিজের বাসায় রেখে পরীক্ষার প্রস্তুতি করানোসহ সার্বক্ষণিক তদারকি করতেন । এমনতর নিবেদিত প্রাণ মহৎ শিক্ষক বর্তমান সমাজে ক,জন দেখা যায় ? তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা ও আন্তরিকতার ফলে এ বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সুন্দর আগামীর আলোকিত জীবনের ছোঁয়া লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে তিনি পাকিস্তান আমলে সিঙ্গিনালা এম ই স্কুলে শিক্ষকতার শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে চোংড়াছড়ি মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনসহ মহালছড়ি বিভিন্ন বিদ্যায়তনে শিক্ষকতা করেন এবং সর্বশেষ মহালছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আহবানে সাড়া দিয়ে বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন ।এ বছর এপ্রিলে ১২ তারিখ স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম ,কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিলেন । বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রমের কারণে আমাকে চিনতে পারেননি,কথাও বলতে পারেন না ।দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিয়ে আসার সময় আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলাম,স্যার সেই কার্ডটা দেখে পকেটে রেখেদিলেন।স্যারের সার্বিক অবস্থা দেখে তন্ময় হয়ে ভাবলাম-যে মানুষটিকে এক সময় প্রাণবন্ত ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর দেখেছিলাম,আজ নির্বাক, নিশ্চল।মহাকালের চিরাচরিত নিয়মে আমাদেরও একই অবস্থার শিকার হতে হবে।এর থেকে নিস্তার পাবার কোনো জো নেই ।স্যারের সরাসরি ছাত্রছাত্রী ব্যতীত নিজের সন্তান- সন্তুতি প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।স্যার জীবনরেখায় পরিপূর্ণ পরমায়ু লাভ করেছেন বলা যায় ।জীবনে আক্ষেপের সুযোগ আছে বলে মনে হয়নি ।
তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই,কিন্তু তাঁর অগণিত ছাত্রের অন্তরে জ্ঞানের স্নিগ্ধ আলোয় জ্বলজ্বল করে থাকবেন অনন্তকাল।কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কবিতার ভাষায় বলতে চাই-

“ চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না- থাকা জুড়ে ।

শ্রদ্ধেয় স্যার,এ মায়াময় পৃথিবী থেকে প্রস্থান করলেও আপনার ছাত্রছাত্রীদের অন্তরে জ্বেলে দেওয়া জ্ঞানদীপ্ত প্রদীপের চিরন্তন শিখায় অম্লান হয়ে থাকবেন।পরম করুণাময়ের নিকট এই প্রার্থনা করি -স্যার ,পরপারে অপার শান্তি লাভ করুক।

লেখক: সোনা মনি চাকমা
যুগ্মসচিব
মাধ্যমিক ওউচ্চ শিক্ষা বিভাগ ।
প্রয়াত বাবু মংসাথোয়াই মাস্টারের ছাত্র

সর্বশেষ - আইন ও অপরাধ

আপনার জন্য নির্বাচিত
%d bloggers like this: