রবিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. জাতীয়
  2. রাঙামাটি
  3. খাগড়াছড়ি
  4. বান্দরবান
  5. পর্যটন
  6. এক্সক্লুসিভ
  7. রাজনীতি
  8. অর্থনীতি
  9. এনজিও
  10. উন্নয়ন খবর
  11. আইন ও অপরাধ
  12. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
  13. চাকরির খবর-দরপত্র বিজ্ঞপ্তি
  14. অন্যান্য
  15. কৃষি ও প্রকৃতি
  16. প্রযুক্তি বিশ্ব
  17. ক্রীড়া ও সংস্কৃতি
  18. শিক্ষাঙ্গন
  19. লাইফ স্টাইল
  20. সাহিত্য
  21. খোলা জানালা

সরেজমিন / প্রায় সময় বন্ধ থাকে বালুখালীর সাপমারা পাহাড় স: প্রা: বিদ্যালয়টি

প্রতিবেদক
সুশীল প্রসাদ চাকমা, রাঙামাটি
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ ১১:১৮ অপরাহ্ণ

রাঙামাটি  জেলার সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের বাঙালি পাড়ায় অবস্থিত সাপমারা পাহাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক বাংলোর দক্ষিণে কাপ্তাই হ্রদের এক দ্বীপ বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে ১৯৯১ সালে। জাতীয়করণ হয়েছে ২০১৩ সালে। বিদ্যালয়ের আশেপাশে ৬৫ পরিবারের বসবাস। কাপ্তাই হ্রদ পরিবেষ্টিত মনোরম একটি টিলায় স্থাপিত বিদ্যালয়টি প্রায় সময় তালা দেওয়া থাকে।

শিক্ষকদের উপস্থিতি অনিয়মিত। শিক্ষকদের অনিয়মিত যাতায়াতের কারণে শিশুরাও বিদ্যালয়মুখী নয়।

বিদ্যালয়ের  প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে কর্মরত ৫ শিক্ষকের মধ্যে রয়েছেন প্রধান শিক্ষকের স্ত্রীও।

সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। খোঁজ নিয়ে জানা যয়, রাঙামাটি শহরের নিকটবর্তী এ সাপমারা পাহাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ২৮।

আবার বিদ্যালয় যেদিন খোলা হয় তখন এসব শিক্ষার্থীর মধ্যেও গড় উপস্থিতির সংখ্যা ৭/৮ জনের বেশি হয় না।

কিন্তু অপর ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদ্যালয়টির ওইসব নগণ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য পদায়ণ দেওয়া হয়েছে ৫ শিক্ষককে। যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে। কর্মরত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতিসহ পাওয়া গেছে ব্যাপক অভিযোগ।

বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক আবদুল মোতালেবের বিরুদ্ধে বিদ্যালয় ফাঁকি দেওয়া, সরকারি অর্থ আত্মসাতসহ অভিযোগ প্রচুর।
খোলার দিন গত বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল নয় টা থেকে দশ টা এবং দুপুর দেড় টা থেকে আড়াই টা পর্যন্ত সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয়টি তখন একেবারে জনশূন্য। সব কক্ষে তালা দেওয়া।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অভিভাবক কারও দেখা মেলেনি। বিদ্যালয়ে তোলা হয়নি জাতীয় পতাকা।

এমনকি কোনো কিছুর তথ্য জানার চেষ্টা করেও আশেপাশে কাউকে পাওয়া যায়নি। বিদ্যালয়ের অদূরে একটি বসতঘর দেখা গেলেও সেখানে মানুষজন ছিলেন না।

পরে বিদ্যালয়টির এমন বাস্তবচিত্রের ওপর ফেসবুকে ভিডিও লাইভ দেওয়ায় বিষয়টি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন মহলে নজরে আসে।

খবর পেয়ে পরের দিন বিদ্যালয়ের একাধিক অভিভাবক রাঙামাটি রিপোর্টার্স  ইউনিটির কার্যালয়ে হাজির হয়ে বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন।

এ সময় প্রধান শিক্ষক আবদুল মোতালেবসহ কর্মরত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির বিষয়ে ব্যাপক অভিযোগের বর্ণনা দেন তাঁরা।
ওই এলাকার স্থানীয় অভিভাবক রুস্তম আলী বলেন, তাদের সাপমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন প্রধান শিক্ষক আবদুল মোতালেবসহ তার স্ত্রী রমজা খাতুন, জামাল উদ্দিন, আয়েশা আক্তার। ৯ সেপ্টেম্বর তৃপ্তি চাকমা নামে আরেক শিক্ষক যোগদান করেছেন।
রুস্তম বলেন, প্রধান শিক্ষক সম্পর্কে আমার চাচা হন।  তিনি মাসের বেশিরভাগ সময় বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকেন না। বিদ্যালয়টি নাকি তার বাবার জায়গায়। সেজন্য এটির অধিকারই নাকি একমাত্র তার।

প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি নিজেই প্রধান শিক্ষক হয়ে স্ত্রীকে সহকারী শিক্ষক করিয়ে একক ক্ষমতায় বিদ্যালয়টি চালু করেছিলেন। পরে মোটা অংকের টাকায় অন্য দুজনকে নিয়োগ করেছেন। এরপর আরেকটি বাড়িয়ে ৫ শিক্ষকের পদ দিয়ে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করে নিয়েছেন। বিদ্যালয়টি পরিচালনার একচ্ছত্র ক্ষমতা তার নিজের হাতেই। এখন বিদ্যালয়ে না গিয়ে বসে বসে বেতন নেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই।

এছাড়াও বিদ্যালয় সংস্কার, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন খাতে পাওয়া সরকারি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে কোনো কাজ করেন না। কিন্তু তার এসব নানা অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে চরম হয়রানী করেন।আমি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনুপস্থিতি ও অনিয়মের ব্যাপারে কথা বলায় তিনি আমার বিরুদ্ধে থানায় একটি বিদ্যালয়ের ব্রাশ, হাড়ি পাতিল, ব্যাটারী ইত্যাদি জিনিসের মোট দেড় লাখ টাকার চুরি মামলা দিয়েছেন। এ মামলায় আমাকে ১৩ দিন জেল খাটতে হয়েছে। পরে এ মামলায় আমি আদালত থেকে খালাস পেয়েছি।

ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিও ভয়ে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেন না। শুরু থেকেই এত বছর ধরে একই দ্যিালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকায় গায়ের জোরে অনেক কিছুই করে যাচ্ছেন তিনি। আমরা তার অন্যত্র বদলি চাই।

রুস্তম আলীর স্ত্রী রুজিনা আক্তার বলেন, আমাদের সাপমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রায় সময় বন্ধ থাকে। জাতীয় পতাকা তোলা হয় না। জাতীয় সংগীত কি- তা শিক্ষার্থী কেউই বলতে পারে না। সেখানে কোনো রকম পড়ালেখা নেই। শিক্ষকরা মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ে গেলেও ক্লাস না করে হাজিরা দিয়ে চলে আসেন। প্রধান শিক্ষক যেদিন স্কুলে যান, সেদিন ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে জঙ্গল কাটান আর ঝাড়ু দিয়ে দেন। তাই সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ রাঙামাটি শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরাও রাঙামাটি শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাচ্ছি। ফলে ওই বিদ্যালয়ে এখন আর ছাত্রছাত্রীও নেই। শিক্ষকরা গিয়ে যেদিন বিদ্যালয় খোলেন, সেদিন বেশি জোর ৭/৮ শিক্ষার্থী গিয়ে উপস্থিত হয়।
আরেক অভিভাবক জামাল হোসেন বলেন, তাদের সাপমারা বিদ্যালয়ে পড়ালেখার মান এতটা খারাপ যে, প্রাথমিক শেষ করা ছাত্রছাত্রী কেউ রিডিং পড়তে পারে না। প্রধান শিক্ষক থাকেন রাঙামাটি শহরে। মাঝে মধ্যে হাজিরা দিতে বিদ্যালয়ে গেলেও ছেলেমেয়েদের পড়ান না। তিনি স্কুলে গেলে আমি যতবার গিয়ে দেখেছি, তখন তিনি টেবিলের ওপর ঘুমান। তার স্ত্রীও স্কুলে যান খুব কম। অন্যরাও একই। সহকারী শিক্ষকরা তার কথার বাইরে চললে নানা হুমকি-ধমকি দেন প্রধান শিক্ষক মোতালেব। সহকারী শিক্ষক জামাল উদ্দিনকে মারধরও করেছেন তিনি।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে কমিটির সালিশি বৈঠকে বিচার হয়েছে বলেও  স্বীকার করেছেন সহকারী শিক্ষক জামাল উদ্দিন।
অভিভাবক মনির হোসেন বলেন, প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রীকে অন্যত্র বদলি করলে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে। তারা মাসে ১০ দিনও ক্লাস করেন না।

তাছাড়া গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর জন্য এই বিদ্যালয়ে ৫ জন শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না। যেসব স্কুলে ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী আছে, কিন্তু শিক্ষক আছেন ২/৩ জন। এ স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অতিরিক্ত শিক্ষকদের ওইসব স্কুলে বদলির দাবি আমাদের।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও বালুখালী ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য লোকমান হোসেন বলেন, কেউ কিছু বলতে গেলে তো প্রধান শিক্ষক তাদের ওপর ক্ষেপে যান। তাই ভয়ে কেউ সহজে মুখ খুলতে চায় না। তবে এলাকার লোকজনসহ অভিভাবকরা প্রধান শিক্ষকের প্রতি ক্ষুব্দ। তাকে অন্যত্র সরিয়ে নিলে ভালো হবে।
এসব বিষয়ে জানতে তার ব্যবহার করা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে পরে কথা বলবেন বলে ফোনের লাইন কেটে দেন প্রধান শিক্ষক আবদুল মোতালেব। কিন্তু আর তিনি কথাও বলেননি, যোগাযোগও করেননি।

পরে মোতালেবের স্ত্রী রমজান খাতুন মোবাইলে প্রথম নিজেকে অবিভাবক পরিচয় দিয়ে সাপমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা বলার চেষ্টা করেন পাহাড়ের খবরের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিমেল চাকমার  কাছে। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।এর সঠিক তদন্ত করে মিডিয়ায় সংবাদ করা দরকার।  এক পর্যায়ে  প্রশ্নের মূখে নিজেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক মোতালেবের স্ত্রী পরিচয় দেন।

তিনি বলেন, ১৪ সেপ্টম্বর তাদের স্কুলে যেতে দেরী হয়েছে সেটা  সঠিক। তাদের স্কুলে নতুন যোগদান করা শিক্ষক দেরী করায় এ সমস্যা হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফিরেছেন কেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষর্থীরা ভাত খেয়ে যায়নি। স্কুলে গিয়ে কান্নাকাটি করছিল তাই ছুটি দেয়া হয়েছে। ছুটির পর নির্ধারিত সময়ের  আগে শিক্ষকরা বিদ্যালয় ত্যাগ করল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন আমার স্বামীর দাঁত ব্যথা শুরু হয়েছিল। স্বামীর দাঁত ব্যথা হলে অন্যরাও কেন বিদ্যালয় ত্যাগ করল জানতে চাইলে বলেন, আকাশে বৃষ্টির মেঘ উঠেছে। বৃষ্টি তুফান হলে স্কুলে থাকা যায় না। সেজন্য চলে এসেছি। বোট যেহেতু একটি সেজন্য সবাইকে ফিরতে হয়েছে। যে বোট নিয়ে ফিরেছেন সে বোটটি কার? জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বোটটি শিশুদের পরিবহনের জন্য ইউনিসেফ দিয়েছে।  ইউনিসেফ  দু বছর তেলের খরচও চালক দিয়েছিল এরপর বন্ধ করে দিয়েছে।  অবিভাবকদের পক্ষেএটি পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না তাই এটি আমাদের দিয়েছে। এটি আমরা ব্যবহার করি। আমার স্বামী এ বোট ঠিক করতে অনেক টাকা খরচ করেছে। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমার সাথে একদিন বিদ্যালয়ে চলেন, অবিভাবকরা আপনাকে সব সত্য কথাগুলো বলবে। আপনি না গেলে অন্য সাংবাদিক নিব।আপনি গেলে খুশি হব। আমি শুনেছি আপনি নাকি খুব সৎ সাংবাদিক। অবিভাবক পরিচয় দিয়ে তারা যে আপনার কাছে অভিযোগ দিয়েছে এগুলো শুনে আমি সারারাত (১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার)  ঘুমাতে পারিনি। আমি মনে করি আমার মান হানি হয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোতালেবের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে একটি কমিটি করে দ্রুত তদন্তের জন্য রাঙামাটি সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়টি বেসরকারি ছিল। সেখানে ৪ জন শিক্ষক ছিলেন। ৫টি শিক্ষকের পদ থাকায় শূন্য পদে সদ্য আরেক শিক্ষককে পদায়ণ দেওয়া হয়েছে। সেখানে যদি শিক্ষার্থীর সংখ্যা নগণ্য পাওয়া যায়, তাহলে কয়েক জনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যাবে।

সর্বশেষ - আইন ও অপরাধ

%d bloggers like this: