রাঙামাটি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও পর্যটকপ্রিয় স্থান হিসেবে সুপরিচিত। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, সাজেকের পাহাড়, কাপ্তাই হ্রদ, ঝুলন্ত সেতু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ণিল সংস্কৃতির কারণে রাঙামাটি এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলো সারা বছর ধরে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে, পাহাড়ি অঞ্চলগুলো আরও সজীব ও সবুজ হয়ে ওঠে, যা পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। পাহাড়ের সবুজাভ আচ্ছাদন, প্রবাহমান ঝরনা, কাপ্তাই হ্রদের শান্ত জলরাশি এবং সাজেকের পাহাড়ি পথের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটকরা ভিড় জমায়। সাজেক, যা “রাঙামাটির মেঘের রাজ্য” নামে পরিচিত, বর্ষার মেঘে ঢাকা পাহাড়ের ভিউ এবং স্নিগ্ধ বাতাস ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। কাপ্তাই হ্রদে নৌকা ভ্রমণ, ঝুলন্ত সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো, এবং পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিং সবকিছুই বর্ষা মৌসুমে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা এনে দেয়। যদিও শুষ্ক মৌসুমেও পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য থাকে, কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বিশেষ করে কাপ্তাই হ্রদ ও সাজেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাজারো পর্যটক এখানে আগমন করেন।
তবে এই বছর বর্ষা মৌসুমে নেই সেই চিরাচরিত পর্যটকদের ঢল। সুনশান নিরবতা বিরাজমান পর্যটন কেন্দগুলোতে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সহিংসতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে রাঙামাটির পর্যটন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখে পড়েছে, যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে। বিশেষ করে সবশেষ পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষকে কেন্দ্র ২৫ সেপ্টেম্বর হতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাজেক ভ্যালি ও ৮ অক্টোবর হতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের রাঙামাটি পার্বত্য জেলা ভ্রমণে বিরত থাকতে অহবান জানালে সাজেক, কাপ্তাই এবং রাঙামাটি শহরের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। শহরের ৬৫টি হোটেল-মোটেল ও ১৭টি ইকো রিসোর্ট এবং কাপ্তাই ও সাজেকে ভ্যালির ১৩২টি কটেজ সম্পূর্ণরূপে পর্যটক শূন্য। এতে করে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, পাহাড়িদের তৈরি পোষাক, সড়ক ও নৌযানসহ অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
সাজেক রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি সুবর্ণ দেব বর্মণ জানান, সহিংসতার পর থেকে সাজেকসহ রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের সংখ্যা শূন্যে নেমে এসেছে। সহিংসতার ফলে পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সাজেক ভ্রমণে ২৫ সেপ্টেম্বর হতে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিরুৎসাহিত করা হয়, যা পর্যটন ব্যবসার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই সাজেকের ১২৭টি রিসোর্ট এবং ১১৬টি রেস্টুরেন্ট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে, ফলে এখানকার পর্যটন ব্যবসায়ীরা দৈনিক ৫০-৬০ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে টানা বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহের কারণে রাঙামাটির নিম্নাঞ্চলগুলোতে কয়েক দফায় বন্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর অনেক বেড়ে যাওয়ায় রাঙামাটির অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ ঝুলন্ত সেতু পানির নিচে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ২৩ আগস্ট থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ৫৬ দিন এই সেতু পানিতে নিমজ্জিত থাকে, যা পুরো পর্যটনখাতকেই সংকটে ফেলে। এই সেতুতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ভিড় জমাতো, যা এই দীর্ঘ সময়ে বন্ধ হয়ে পড়ে।
রাঙামাটি পর্যটন ও হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা জানান, সেতুটি পানিতে ডুবে থাকায় ও পর্যটক ভ্রমণে বিরত থাকার কারণে পর্যটকদের আগমন পুরোপুরি থেমে গেছে এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আসা করছি পর্যটকদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক আগমন ঘটবে। নৌকা চালক মোঃ আলমগীর জানান, দীর্ঘ সময় ধরে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ডুবে ছিলো ঝুলন্ত সেতু। তাই পর্যটকদের জন্য কোনো নৌকা ভ্রমণ সম্ভব হচ্ছিলো না। তাছাড়া পাহাড়ে সংঘর্ষ ও পর্যটকদের ভ্রমণে বিরত থাকতে বলার কারণে কোনো পর্যটক নেই। এতে আর্থিকভাবে আমরা চরম লোকসানে আছি। নৌকা চালকরা চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন।
রাঙামাটি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, গত ২ মাস ধরে রাঙামাটি পর্যটন খাত ও আবাসিক হোটেল মোটেল গুলোতে ২০কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। এ লোকসান কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়িদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। পর্যটন ব্যবসার সাথে হোটেল রেস্তোরাসহ অন্যান্য আরো অনেক কিছু জড়িত রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বড় ধরনের এক ধাক্কা বয়ে যাচ্ছে আমাদের উপর।
কাপ্তাই নিসর্গ হাউজ পট এর ম্যানেজার মাসুদ বলেন, কাপ্তাই এখন পর্যটক শূন্য বললেই চলে। প্রথম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, তার পর স্থানীয় ছাত্র আন্দোলন, পরে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি বাঙালি সংঘাত সংঘর্ষ এর পর রাঙামাটি শহরে পাহাড়ি বাঙালি সহিংসতা। সবকিছু মিলিয়ে পর্যটন খ্যাতে ধস নেমে এসেছে। মনে করেছিলাম বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে একটু ঠিকঠাক মত ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবো। এবার টানা দুর্গা পুজার বন্ধেও কোন পর্যটক ছিলো না। তাই মন ভাল নেই এই পেশার ব্যবসায়িদের।
কাপ্তাই হ্রদের ইঞ্জিল চালিত বোট মালিক সমিতির ম্যানেজার শীতল কান্তি বলেন, গত ১৫ দিন ধরে ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র আপস্টিম জেটিঘাটেও কোন পর্যটক আসেনি। ব্যবসার প্রতিটি খাতে যে সকল শ্রমিক কর্মচারী সম্পৃক্ত তাদের উপার্জনও কমে গেছে। সব মিলেয়ে তাদের কয়েক কোটি টাকা আয় করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা। এটা একটা বড় ধাক্কা বললেই চলে। তারা আরও বলেন, শান্তি পাহাড়ে যারা অশান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। এভাবে চললে আমরা বাঁচবো কী করে? এ ভাবে তো বেশি দিন চলা যায় না।
সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাঙামাটির পর্যটন খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে পুনরায় পর্যটন ব্যবসা গড়ে তোলার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। প্রশাসনের প্রচেষ্টা, নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং পর্যটকদের নতুন করে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে রাঙামাটি, কাপ্তাই ও সাজেকের পর্যটন শিল্প ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এলে, রাঙামাটি এবং পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন আবারও ঘুরে দাঁড়াবে এবং স্থানীয় অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমাও জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটকদের ভ্রমণে বিরত থাকার যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাও দ্রুত তুলে নেওয়া হবে।