অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে রাঙামাটি জেলায় শ্রেষ্ঠ জয়িতা নারীর সম্মাননা পেলেন কাপ্তাই উপজেলার ৪ নং কাপ্তাই ইউনিয়ন এর ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রিজামনি।
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে গত সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাঙামাটি জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা এবং জয়িতা নারী সম্মাননা অনুষ্ঠানে তাঁকে ক্রেস্ট এবং সনদপত্র তুলে দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নাসরিন সুলতানা।
এ সময় রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ঋষিকেশ শীল, জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ পরিচালক অনুকা খীসা সহ নারী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে মঙ্গলবার ( ১০ ডিসেম্বর) এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় জেলায় জয়িতা নারীর সম্মাননা পাওয়া রিজামনির সাথে।
তিনি বলেন, আমি একজন গৃহিনী ও উদ্যোক্তা। গৃহিনী থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প এত সহজ ছিল না আমার জন্য। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমি আজ এই পর্যায়ে এসেছি, নিজেকে স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হয়েছি। আমার মা গৃহিনী, বাবা একজন চাকুরীজীবি ছিলেন। আমরা চারজন ভাই-বোন। ২০০৬ সালে ডিসেম্বরে খুব ছোট বয়সে ব্যবসায়ী স্বামীর সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়, তখন আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। তখনও আমার উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হয়নি। বিয়ের পর আমি ফাইনাল পরীক্ষা দিই। এরপর শশুর বাড়ীতে থেকে বাধা থাকাতে ইচ্ছে থাকলেও আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারিনি।
শশুরবাড়িতে চাকরি করা, পড়ালেখা করা এগুলো পছন্দ করত না। এমনকি ঘর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত যেত না। যার কারণে কিছু করা কখনও সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে আমার নিজের স্বপ্নগুলোও ভেঙে যেতে লাগলো। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে একজন আদর্শ বউ হওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। বন্ধু বান্ধবীদের যখন দেখলাম তারা গ্র্যাজুয়েশন করছে, জব করছে তখন নিজের স্বপ্নগুলোও খুব করে উঁকি দিত মনে। এভাবেই দিন যাচ্ছিল, হঠাৎ ভাবনা এল এভাবে স্বামীর উপর নির্ভরশীল না থেকে, বসে না থেকে কিছু একটা করা যায় কিনা। কিন্তু করার কিছুই ছিল না। অনলাইনে অনেক ঘোরাফেরা করতাম, দেখতাম কিছু করা যায় কিনা, অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি। এরপর ২০২০ সালে একটা গ্রাফিক্স কোর্স এ ভর্তি হই। পরিবারের সবাইকে রাজি করিয়ে অনেক কষ্টে কোর্সটা করি। কিন্তু পরবর্তীতে ল্যাপটপ না থাকার কারণে ফ্যামিলিগত বাধাঁ থাকাতে সেটাও কন্টিনিউ করতে পারিনি। পরবর্তীতে ২০২১ সালে আবার চিন্তা করলাম কি করা যায়, এমন কাজ যা আমি ঘরে বসে করতে পারি, ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে, স্বামীর ব্যবসাও ভাল যাচ্ছিল না, খরচও বাড়ছে। এমন অবস্থায় আমি চিন্তা করলাম আমি মিষ্টি বানানো শিখেছিলাম অনেক আগে আমার পরিবারের একজন সদস্য থেকে। সেটা আরও ১০ বছর আগে, মাঝে মাঝে বাসায় বানাতাম। চিন্তা করলাম এটা নিয়েই কাজ শুরু করি। তখন সময়টা ছিল ২০২১ সালের নভেম্বর মাস। অনলাইনে একটা গ্রুপ এ জয়েন হলাম। গ্রুপ এর নাম ছিল “কাপ্তাই ফোরাম অনলাইন বেচা-কেনা”। গ্রুপের এডমিন ছিল আলিব রেজা লিমন। আমি ওর সাথে কথা বললাম, সে বলল আপু আপনি পোষ্ট করেন আমরা আছি অবশ্যই সেল হবে। একটা পেইজও খুলে নিলাম। মিষ্টি নিয়ে যেহেতু শুধু করব তাই নাম দিলাম “মিষ্টিমুখ”। তারপর পোষ্ট দিলাম কয়েকটা মিষ্টির আইটেম দিয়ে। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যার দিকেই একটা ম্যাসেজ আসলো সালাম দিলাম, বললেন,” আমি কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান। আমাকে আগামীকাল সকালে আপনি ২ কেজি মিষ্টি, ৪০ পিস রোল দিতে পারবেন। আমি ১ মিনিট চিন্তা না করেই বলে দিলাম জি স্যার পারব। তৎক্ষনাৎ আমি কাজও শুরু করে দিলাম। তখন হাতে ছিল মাত্র ৫০০ টাকা।
আমি পরেরদিন সকালে ডেলিভারী দিলাম ৪০ পিস রোল এবং ২ কেজি মিষ্টি। স্যার খেয়ে অনেক প্রশংসা করলেন। অনেক খুশি হলেন। এভাবেই স্যার থেকে ভাল রিভিউ পেয়ে আমার উৎসাহ আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তখন আমার স্বামী শশুড় থেকে লুকিয়ে আমি কাজ করা শুরু করি। কারণ, উনাদেও কাছে আমি অনুমতি পাব না সেই ভয়ে আর বলিনি। তবে ফ্যামিলির কিছু কিছু মানুষ আমাকে সাপোর্ট করেছে পাশে থেকেছে। আর আমার মা-বাবা ভাই-বোন থেকেও আমি অনেক উৎসাহ পেয়েছি। এভাবেই আস্তে আস্তে আমার অর্ডার আসতে লাগলো।
কাস্টমারদের চাহিদার কারণে কয়েকটা আইটেম দিয়ে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে আমার পেইজে কেক, মিষ্টি, দেশীয় পিঠা সহ আরও বিভিন্ন ধরনের চাইনিজ ফাস্ট ফুড, পিজ্জা সহ অনেক আইটেম নিয়ে কাজ করি। তবে সবকিছু আমার নিজে নিজেই শিখা। ইউটিউব এর সাহায্য নিতাম মাঝে মাঝে। যখন না পারতাম, অনেক বড় অর্ডার হলেও আমি নিয়ে ফেলতাম কখনও পারবো না এটা মনে আসত না। সব সময়ই পারতাম। পারব এটাই আমার শক্তি ছিল। অনেক সময় দেখা গেছে আমি পুরো রাত জেগে কাজ করে আবার সকালে ডেলিভারী দিয়েছি। আবার সংসারের কাজও করেছি। আগে ফ্যামিলির যারা রাজি ছিল না তারাও আমার সফলতা দেখে আমাকে আর বাধা দেয় নাই, সবাই মেনে নিয়েছে। কাপ্তাই ইউএনও মুনতাসির জাহান স্যার থাকাকালীন উনি একটা প্রশিক্ষণ এর আয়োজন করেন যেখানে আমি ২৫ জন নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছিলাম ২০২২ সালের ১৯ মে। আমাকে সার্টিফিকেটও দিয়েছিল সফল প্রশিক্ষক হিসেবে। আগে যেখানে আমার ইনকাম করা একটা স্বপ্ন ছিল এখন আমি মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা ইনকাম করি আলহামদুলিল্লাহ। আমার নিজের খরচ আমি নিজে বহন করি এবং ফ্যামিলিতে সাপোর্ট দিতে পারি। সমাজে আমাকে এখন আমার পরিচয়ে চিনে। আমি নিজের একটা পরিচয়ে সবার মাঝে পরিচিত হতে পেরেছি এবং এখন আমার পরিবারও আমাকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে। আমি চাই আমার স্বাস্থ্যকর হোমমেইড খাবারগুলো সকলের মাঝে পৌঁছে দিতে এবং আমার মত অনেক নারী যার সুবিধাবঞ্চিত তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান করতে পারে। আমার পেইজ “মিষ্টিমুখ” একটি ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চাই সবার সহযোগিতায় চাই।
কাপ্তাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রিনি চাকমা বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রা ও নারীর অগ্রযাত্রা পরস্পর পরিপূরক।এ যাত্রাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সমাজের সংগ্রামী নারীদের সমাজের মধ্যে বিরাজমান সকল প্রকার বিভ্রান্তি ও আশংকা দূর করে নারীদেরকে সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে শক্তিতে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে মহিলা ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এর মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে বেগম রোকেয়া দিবসে, যে সকল নারী প্রতিকূলতাকে জয় করে পরিবারে,সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের ত্যাগ, প্রচেষ্টা ও সংগ্রামকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা রিজা মনি আকতার এবং সেই সংগ্রামী সকল নারীরা আরো এগিয়ে যাক এ প্রত্যাশা ও শুভকামনা জানাই।