আগুনের লেলিহান শিখা নিভলেও সাজেকের আকাশে এখনো ধোঁয়ার ছায়া। রিসোর্ট-কটেজের ধ্বংসস্তূপ, পোড়া কাঠের স্তূপ আর হতাশ মুখের সারি—সাজেক যেন এক শূন্যতার নগরী। গত সোমবারের লেলিহান আগুনে মেঘের রাজ্য খ্যাত সাজেকে পুড়ে গেছে ৯৭টি রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, দোকান ও বসতঘর। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন সংখ্যাটি আরও বেশি, প্রায় ১২০টিরও বেশি স্থাপনা ভস্মীভূত হয়েছে। সাজেক কটেজ মালিক সমিতির দাবি, ৩৫টি বসতঘর বাদ দিলে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তবে স্থানীয়দের মতে, এই ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পরপর সাজেক ভ্রমণে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করা হলেও আজ মঙ্গলবার দুপুর থেকে নিরুৎসাহিতকরণ প্রত্যাহার করা হয়। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া রিসোর্ট, বসতবাড়ি ও দোকানগুলোর মালিকরা দাঁড়িয়ে আছেন ভস্মীভূত স্থাপনাগুলোর সামনে। সবকিছু হারিয়ে তাদের চোখে-মুখে এক অনিশ্চয়তার ছাপ।
সাজেকের ভয়াবহ আগুনের পর আজ মঙ্গলবার সকাল থেকেই স্থানীয়রা ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষতে ব্যস্ত। আগুনে ৩৪টি রিসোর্ট, ৩৭টি বসতঘর, ৭টি রেস্টুরেন্ট ও ১৯টি দোকান সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এখনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া। পুড়ে যাওয়া কাঠের স্তূপের নিচে জীবনের সংগ্রাম খুঁজছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও, ততক্ষণে সব শেষ। সাজেকের কোনো ফায়ার স্টেশন না থাকায় খাগড়াছড়ি, পানছড়ি ও দীঘিনালা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো আসতে দেরি হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পেদা টিংটিং রেস্টুরেন্টে ও মাচাং বিলাস রিসোর্টের স্বত্তাধিকার মোঃ আব্দুল রাজ্জাক বলেন, আমি আমার ২টা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করেছি, আমার এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আগুনে পুড়ে আমার সব ছাঁই হয়ে গেছে। সাজেক দেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র কিন্তু এখানে কোন ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন নেই। যার ফল আজকে আমরা ভোগ করলাম। সাজেকে একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থাকলে ও পানির ব্যবস্থা থাকলে আমরা এতগুলো ব্যবসায়ী ও পরিবারকে নিঃস্ব হতে হয়না। আমরা চাই পর্যটনকে কেন্দ্র করে দ্রুত যেনো ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন স্থাপন করা হয়।
চিলিকোটা রেস্টুরেন্টের সত্ত্বাধিকার বলেন, আমি গত বছর নতুন করে আমার রেস্টুরেন্টটি প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা দিয়ে সাজাই। তারপর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা, বিভিন্ন সময় বন্ধের কারণে আমরা তেমন একটা ব্যবসা করতে পারিনি। যখনই এই সব অস্থিরতা কাটিয়ে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি তখনই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। আমি গতকালে এই সময় ২০-৩০ লক্ষটাকার মালিক ছিলাম। আর আজকে ঠিক এই সময়ে আমি পথের ফকির। আগুন যখন লাগে তখন বাতাসের তীব্রতা অনেক বেশী ছিলো তাই আগুন অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া সাজেকে পানি স্বল্পতার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর পাশাপাশি সাজেকে যেহেতু ফায়ার সার্ভিস নেই তাই পাশের জেলা থেকে ফায়ার সার্ভিস আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে আগুন আমাদের নিঃস্ব করে দেয়।
সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ণ দেব বর্মন বলেন, সাজেক অগ্নিকাণ্ডে আমাদের প্রায় ৩৪টি রিসোর্ট, বসতবাড়ি ৩৭টি, দোকান ১৯টি, রেস্টুরেন্ট ৭ টি পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। বসতবাড়ি আমরা এখনো হিসাব করতে পারিনাই, তবে ৩৪টি রিসোর্ট, ১৯টা দোকান এবং ৩৭টি রেস্টুরেন্ট মিলে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। যা আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদকরা মিলে সরজমিনে পরিদর্শন করে হিসাব করেছেন। তবে এখনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।
বাঘাইহাট জোনের জোন অধিনায়ক লে. কর্ণেল খাইরুল আমিন (পিএসসি) বলেন, সাজেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমরা সাথে সাথেই রেস্পন্স করি। আর্মি, বিজিবি, পুলিশ,ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়রা মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। যদিও ফায়ার সার্ভিস আসতে কিছুটা সময় লেগেছে। আমাদের সাজেক এলাকায় কোন ফায়ার সার্ভিস না থাকায় পাশের উপজেলা দীঘিনালা থেকে তারা আসতে আসতে প্রায় ২ঘন্টা সময় লেগে যায়। পরবর্তীতে সবার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আনুমানিক বিকেল ৫টার পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়, কিন্তু পুরোপুরি নিভানো সম্ভব হয়নি। রাত্র ২টার দিকে আগুন নিভানো সম্ভব হয়। সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিস ও আমরা পরিদর্শন করে দেখেছি কোথাও আগুন ছড়ানোর মত আগুনের অস্তিত্ব আর নেই। আমরা অনুমান করছি চুলার আগুন, শর্টসার্কিট বা সিগারেটের আগুন এই ৩টি কারনে হয়তো আগুন লাগতে পারে। তবে নাশকতার বিষয়ে আমাদের কাছে কোন আলামত নেই।