কঠোর দারিদ্র্যতার মধ্যে জন্ম নেওয়া এক মেধাবী এবং স্বপ্নজয়ী নারী প্রিয়া চৌধুরী। জন্ম চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সৈয়দবাড়ি গ্রামে। কিন্তু জন্ম নেওয়ার মাত্র ৮ মাসের মাথায় পিতৃহারা হন প্রিয়া। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রোয়াজার হাট বাজারে নিজ দোকানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তাঁর পিতা পংকজ চৌধুরী ১৯৯৮ সালে সকলকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে যান। এসময় একমাত্র বড় বোন সঞ্চিতা চৌধুরীর বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁর মা প্রভা চৌধুরীর জীবন যুদ্ধ শুরু হয়। এই যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ। এরপর তাঁর মা প্রভা চৌধুরী সংসারের হাল ধরেন। প্রথমে তিনি রাঙ্গুনিয়া ইছাখালীতে একটি বেসরকারি এনজিও তে স্বল্প বেতনে চাকরি নেন। এই বেতনে তাঁর মেয়ে দুইজনের ভরণ পোষণ করতে হিমশিম খাওয়ায় পরবর্তীতে চন্দ্রঘোনা জেনারেল হাসপাতালে এটেনডেন্ট পদে চাকরি নেন। এই চাকরি করতে করতে তিনি তাঁর মেয়ে দুইজনের পড়ালেখা চালিয়ে যান। তাদের মধ্যে তাঁর ছোট মেয়ে প্রিয়া চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) হতে পুরকৌশল বিভাগে ২০২১ সালে স্নাতক এবং ২০২৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সেই সময়ে চুয়েট এর পুর ও পরিবেশ কৌশল অনুষদে ১৬০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে ২০২২ সালে জুলাই মাসে তিনি চুয়েট এর পানি সম্পদ কৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকার দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ টেনেসি এড চাটানোগা এ PhD in Computational Engineering এ ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাত সাড়ে ৮টায় চন্দ্রঘোনা হিন্দু পাড়া প্রিয়ার নিজ বাসস্থান ” সুন্দরাচল” এ কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এসময় প্রিয়া চৌধুরী তাঁর জীবনের সংগ্রামের কথা শুনান এই প্রতিবেদককে। প্রিয়া বলেন, আমি কখনো আমার বাবাকে দেখি নাই, কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে মা’ ই আমাকে বাবার অভাব পূরণ করে দেন। রোয়াজার হাট হতে আমরা ১৯৯৮ সালে চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান বনগ্রাম এলাকায় মাসির বাসায় চলে আসি। মাসি এবং মাসিত ভাইদের স্নেহ মাখা পরিবেশে আমি বড় হতে থাকি। মা স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন। এরপরও আমাদের দুইজনকে পড়ালেখা করান মা। দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও আমাদের পড়ালেখার জন্য মা সব কিছু করেন। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু হয় কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা বি এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ২০১৩ সালে আমি কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে বিজ্ঞান বিভাগে ৪.৬৩ পয়েন্ট পেয়ে এসএসসি পাস করি। তখন হতে আমি রাত দিন টিউশন করে নিজের পড়াশোনার খরচ বহন করি। এরপর ২০১৫ সালে রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজ হতে বিজ্ঞান বিভাগে আমি ভালো ফলাফল অর্জন করি। সেই সময় আমার ফলাফল ছিল গোল্ডেন এ প্লাস। সমগ্র রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় আমি প্রথম স্থান অধিকার করি।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালে আমি চুয়েট এর পুর ও পানি সম্পদ কৌশল বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ভর্তি হই। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হই। চুয়েট এ ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ যোগাতাম, সেই সময় আমি কঠোর পরিশ্রম করতাম। এমন দিন গেছে দিনে ৫ টা টিউশন করেছি। বর্তমানে আমি চুয়েট এর ঐ বিভাগে প্রভাষক হিসাবে শিক্ষকতার পাশাপাশি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করি। এরই মধ্যে আমি ২০২৫ সালে জানুয়ারি মাসে আমেরিকার দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ টেনেসি এড চাটানোগা এ PhD in Computational Engineering এর জন্য আবেদন এর প্রেক্ষিতে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পাই। চলতি বছরে আমার ক্লাস শুরু হবে।
প্রিয়া চৌধুরী তাঁর এই ক্যারিয়ারে আসার পেছনে কৃতজ্ঞতা জানান তাঁর মামা অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার জেনারেল আনন্দ মোহন দত্ত, রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজ এর অধ্যক্ষ মো: সরোয়ার সিকদার, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও চুয়েট এর শিক্ষক মন্ডলী, চন্দ্রঘোনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকবৃন্দ, তাঁর মাসি চন্দনা রানী বিশ্বাসের পরিবার এবং তার সকল বন্ধুদের প্রতি। কেননা প্রতিটি মুহূর্তে এই মানুষগুলো তাঁকে সহযোগিতা করেছেন।